‘ডাইনি’ সন্দেহে একই পরিবারের ৫ সদস্যকে পুড়িয়ে হত্যা

ভারতে জাদুবিদ্যা চর্চার অভিযোগে ‘ডাইনি’ সন্দেহে এক পরিবারের পাঁচ সদস্যকে নির্মমভাবে পিটিয়ে ও জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে। এই মর্মান্তিক ঘটনার তিন সপ্তাহ পরও বিহার রাজ্যের টেটগামা গ্রামে আতঙ্ক ও নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে, আর বেঁচে থাকা মানুষগুলো এখনো সেই ভয়াবহতা ভুলতে পারছেন না। খবর বিবিসির।
গত ৬ জুলাই রাতে এই ঘটনা ঘটে। রাত ১০টার দিকে উত্তেজিত জনতা ৭১ বছর বয়সী বিধবা কাতো ওরাওঁ-এর আত্মীয়দের বাড়ির বাইরে জড়ো হয়। ভোরের মধ্যে কাতো ওরাওঁসহ তার পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হত্যা করা হয়। নিহতদের মধ্যে কাতোর বড় ছেলে বাবুলাল ওরাওঁ, তার স্ত্রী সীতা দেবী, তাদের ছেলে মনজিত ও পুত্রবধূ রানী দেবীও ছিলেন। শুধু বাবুলালের কিশোর ছেলেটি কোনোমতে প্রাণে বেঁচে ফিরে আসে।
ভারতে জাদুটোনার সন্দেহে হত্যার ঘটনা নতুন নয়। জাতীয় অপরাধ রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে ভারতে ‘জাদুবিদ্যা’ সন্দেহে দুই ৫০০ জনেরও বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল, যাদের বেশিরভাগই নারী। তবে টেটগামার এই ঘটনা বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ একই পরিবারের পাঁচজন সদস্যকে এক সঙ্গে এমন নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে।
এই ঘটনা আবারও ভারতের সুবিধাবঞ্চিত উপজাতি সম্প্রদায়গুলোতে প্রচলিত কুসংস্কারের ভয়াবহ রূপ তুলে ধরেছে। অভিযুক্ত খুনি ও নিহতরা সবাই ওরাওঁ উপজাতির সদস্য ও তারা প্রজন্ম ধরে পাশাপাশি বসবাস করে আসছিলেন। কিন্তু ওই রাতের ঘটনা তাদের মধ্যে এমন এক বিভেদ তৈরি করেছে যা হয়তো আর কখনোই মিটবে না।
বর্তমানে টেটগামা গ্রামের রাস্তাগুলো নীরব। কাতো দেবীর চার ছেলের পরিবার ছাড়া গ্রামের প্রায় সব বাসিন্দা ভয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে। অনেক বাড়িতে তালা ঝুলছে, আবার কিছু বাড়ি তাড়াহুড়ো করে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে আছে।
বিবিসি নিহতদের আত্মীয়স্বজন, পুলিশ ও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে সেই রাতের ভয়াবহ বিবরণ তুলে ধরেছে। এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মনীষা দেবী (ছদ্মনাম) জানান, তিনি গভীর রাতে গোলমালের শব্দ শুনেছিলেন ও বাবুলাল ওরাওঁর বাড়ির বাইরে এক বিশাল ভিড় দেখতে পান।

পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে গ্রামবাসী রামদেব ওরাওঁকে প্রধান অভিযুক্ত করা হয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, রামদেবের ছেলে প্রায় ১০ দিন আগে অসুস্থ হয়ে মারা গিয়েছিল। রামদেব তখন কাতো দেবী ও তার পরিবারের বিরুদ্ধে জাদুবিদ্যার মাধ্যমে তার সন্তানকে হত্যার অভিযোগ তোলেন। এই অভিযোগের পেছনের কারণ এখনো স্পষ্ট নয়। পুলিশ জানিয়েছে, রামদেব পলাতক।
মনীষা দেবী অভিযোগ করেছেন, সে রাতে কিছু ‘ভূতপ্রেত’ (সম্ভবত স্থানীয় ওঝা বা ভণ্ড ব্যক্তি) কাতো দেবী ও বাবুলালের স্ত্রী সীতা দেবীকে ‘ডাইনি’ আখ্যা দিয়ে রামদেবের পরিবারের অসুস্থতা ও মৃত্যুর জন্য তাদের দায়ী করেন। এরপর জনতা কাতোকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনে ও অসুস্থ কিশোরীকে সুস্থ করার জন্য তাকে আধঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়। সীতা দেবী যখন তার স্বামীকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন, তখন জনতা তাকেও আক্রমণ করে।
বেঁচে যাওয়া কিশোর ছেলেটি পরে পুলিশকে জানায়, সে কোনোভাবে পালিয়ে অন্ধকারে লুকিয়ে পড়েছিল, তার পরিবারকে পিটিয়ে হত্যা ও পুড়িয়ে মারার মর্মান্তিক দৃশ্য প্রত্যক্ষ করে।
পুলিশের অভিযোগে গ্রামের ২৩ জন পুরুষ-মহিলা ও ১৫০ থেকে ২০০ জন অজ্ঞাত ব্যক্তির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, জনতা লাঠি, রড ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে নিহতদের দড়ি দিয়ে বেঁধে গ্রামের পুকুরে টেনে নিয়ে যায় ও পুরো পথ তাদের ওপর নির্যাতন চালায়। এরপর ‘অর্ধমৃত’ অবস্থায় তাদের ওপর পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, দেহগুলো বস্তায় ভরে ট্র্যাক্টরে করে নিয়ে যাওয়া হয়।
পরের দিন একজন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা সাংবাদিকদের জানান, নিহতদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছে ও তাদের পোড়া দেহ গ্রামের কাছের একটি পুকুর থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। যদিও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পরে বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মৃত্যুর সঠিক কারণ স্পষ্ট করে বলা হয়নি।
এই ভয়াবহ ঘটনাটি মুফাসিল থানা থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার দূরে ঘটেছিল, কিন্তু পুলিশ প্রায় ১১ ঘণ্টা পর জানতে পারে। জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অংশুল কুমার স্বীকার করেছেন, এটি পুলিশের ‘ব্যর্থতা’। যদিও তিনি দাবি করেন, ‘পুরো সম্প্রদায় জড়িত’ থাকায় এই বিলম্ব হয়েছে। ঘটনার পর দায়িত্বপ্রাপ্ত অফিসার-ইন-চার্জকে (থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) বরখাস্ত করা হয়েছে।
স্থানীয় সমাজকর্মী মীরা দেবী বিবিসিকে বলেছেন, আদিবাসী গ্রামগুলোতে শিক্ষার অভাব রয়েছে, তারা ডাক্তার বা ওষুধের চেয়ে ‘ভূতপ্রেত’দের ওপর বেশি নির্ভর করে।
গ্রাম পরিষদের প্রধান সন্তোষ সিং জানান, বেশিরভাগ শিশু স্কুল ছেড়ে তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে কাছাকাছি ইটভাটায় কাজ করে। স্থানীয় শিক্ষক ইন্দ্রানন্দ চৌধুরী নিশ্চিত করেছেন, স্কুলে নাম লেখানো মাত্র তিনজন শিশুর কেউই নিয়মিত আসে না।
পূর্ণিয়া শহর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই টেটগামা গ্রামে ২২টি পরিবারের বসবাস। এই মর্মান্তিক ঘটনাটি গ্রামের মানুষের মনে গভীর প্রভাব ফেলেছে। মনীষা দেবী নিজের বাড়ির বাইরে বসে সেই রাতের বীভৎসতা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, আমরা অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে ছিলাম, ভুক্তভোগীরা নিজেদের বাঁচানোর জন্য মরিয়া চেষ্টা করছিল তা দেখছিলাম। সেই দৃশ্য এখনো আমাদের তাড়া করে।