২২ শ্রাবণের আগেই ভারাক্রান্ত শান্তিনিকেতন

রাত পোহালেই কাল শনিবার ভারতে ২২ শ্রাবণ। এর আগে থেকেই ভারাক্রান্ত হয়ে আছে শান্তিনিকেতন। সেখানকার পরতে পরতে বিষাদের ছায়া স্পষ্ট। ২২ শ্রাবণ মানেই যে বিষাদের দিন। শান্তিনিকেতনের বুকে আশ্রমগুরু রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি তর্পণের দিন। বাংলা সন বা তারিখ আমরা প্রায় ভুলতে বসেছি। ২৫ বৈশাখ দিনটি বিশ্বজুড়ে সাড়ম্বরে ও মহা সমারোহে পালিত হলেও ২২ শ্রাবণ সেই তুলনায় অনেকটা ম্যাড়মেড়ে। অথচ ২৫ বৈশাখ এবং ২২ শ্রাবণ বাঙালির সহায় সম্বল।
বাংলাদেশে গত ৬ আগস্ট ছিল ২২ শ্রাবণ। তবে ভারতের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী ২২ শ্রাবণ হবে ৮ আগস্ট।
রবীন্দ্রনাথের মতন ঋষিকল্প, অত বড় মহাজীবনের আবির্ভাব পৃথিবীতে প্রতিদিন ঘটে না। বিশ্বকবির দীর্ঘ জীবনের সেই অপূর্ব জীবনসংগীত ধীর ধীরে এসে থেমে গেল ১৯৪১ সালের ২২ শ্রাবণ। আজও সেই বিষাদ সংগীতের মূর্ছনা আশ্রমের আকাশ বাতাস ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে। এখনো শান্তিনিকেতন, শ্রীনিকেতন, বোলপুর তথা বীরভূমবাসীদের কাছে এই দিনটির একটা স্বতন্ত্র তাৎপর্য রয়েছে। বিশেষ করে এই দিনটিতে রবীন্দ্রনাথের একটা আত্মিক প্রভাব অনুভব করা যায়। কবির তিরোধানের পর থেকেই শান্তিনিকেতনের বুকে যেন কোথাও একটা গভীর বেদনা ছড়িয়ে গেছে। বছরের অন্য সময় সেটা গোপন থাকলেও শ্রাবণে তা প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে স্ফুটবাক ও বেদনাবিথারী।
শান্তিনিকেতনের বুকে ২২ শ্রাবণ দিনটির তাৎপর্য বরাবরই অন্যরকম। এই দিনটিকে এখানে নবজীবনের উৎসব হিসেবে পালন করা হয়। কবির প্রয়াণের পরের বছর ১৯৪২ সাল থেকে ২২ শ্রাবণ শান্তিনিকেতনে বৃক্ষরোপণ উৎসব হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। বিচিত্রতার রূপকার রবীন্দ্রনাথ বরাবরই বৃক্ষকে দেখেছিলেন প্রাণের প্রতীক হিসেবে। একদিকে জীবনের এক পর্বান্ত, আর অন্যদিকে জীবনবৃক্ষের অনন্ত সম্ভাবনার দ্বার উদঘাটন। একই সঙ্গে শান্তিনিকেতনের বুকে পূরবী ও বিভাসের এই সম্মেলক সুর ধ্বনিত হয় ২২ শ্রাবণে। পৃথিবীর মরুবিজয়ী বৃক্ষকে ‘আদিপ্রাণ’ হিসেবে দেখেছিলেন কবি। তাঁর কাছে বৃক্ষবন্দনার মানে ছিল প্রাণের উপাসনা। তাই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ও বৃক্ষরোপণ প্রতীকী তাৎপর্যে অঙ্কিত। ২২ শ্রাবণে শান্তিনিকেতনে বৃক্ষবন্দনায় প্রকৃতি ও ক্ষয়হীন জীবনের জয়গান ধ্বনিত হয়।
বিষাদের দিনেও নতুনের বার্তা নিয়ে ২২ শ্রাবণ ফিরে আসে প্রতিবছর। আমৃত্যু প্রাণের জয়গান গেয়ে গেছেন কবি। রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে বারবার শোনা গেছে, ‘মরণ রে তুঁহু মম শ্যাম সমান’। এই মৌসুমি মাস কবির কাছে ছিল অতিপ্রিয়। কবি তাঁর লেখায় বলেছেন, শ্রাবণ হচ্ছে জাগরণের মাস। কবির কবিতায়, গানে, নাটকে, প্রবন্ধে বিভিন্ন চিঠিপত্রে তিনি যেমন শ্রাবণ বন্দনার নানা রূপকে তুলে ধরে প্রাণের জয়গান গেয়েছেন। একইভাবে তিনি উপলব্ধি করেছেন মৃত্যুর নির্মমতা, অনিবার্যতা ও রহস্যকে। কবি তাঁর ‘প্রভাত সঙ্গীত’ কাব্য রচনার মাধ্যমে উপলব্ধি করেছিলেন, মৃত্যুতে মানবসভ্যতার ধ্বংস হয় না। সৃষ্টির বিকাশ ঘটে না। মৃত্যুবন্দনা ছিল রবীন্দ্রকাব্য জীবনের এক বড় অধ্যায়। অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা এক চিঠিতে কবি লিখেছিলেন, ‘জীবনকে মৃত্যুর জানালার ভিতর থেকে না দেখলে তাকে সত্যরূপে দেখা যায় না। মৃত্যুর আকাশে জীবনের যে বিরাট মুক্তরূপ প্রকাশ পায়, প্রথমে তা বড় দুঃসহ। কিন্তু তারপর তার ঔদার্য্য মনকে আনন্দ দিতে থাকে। তখন ব্যক্তিগত জীবনের সুখ-দুঃখ অনন্ত সৃষ্টির ক্ষেত্রে হালকা হয়ে দেখা দেয়...’
কবির কথায়- ‘জন্মান্তরের নব প্রভাতে’। জন্মদিন নিয়ে আসে নব প্রভাতের অরুণ রাগ, আর মৃত্যুদিন বিস্তার করে দিনাবসানের অস্তমাধুরী। ‘মৃত্যুঞ্জয়’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে লিখে গিয়েছেন, ‘আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়ো এই শেষ কথা বলে যাবো আমি চলে’। কবির কথায় মৃত্যু হলো জীবনের শেষ পরিপূর্ণতা।
শান্তিনিকেতন থেকে রবীন্দ্রনাথের শেষযাত্রার দিনটি ছিল ১৯৪১ সালের ২৫ জুলাই। এই দিনেই বোলপুর স্টেশন থেকে কবিকে কলকাতা নিয়ে যাওয়া হয় চিকিৎসার জন্য।
কবির একান্ত স্নেহধন্যা এবং রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (মোহরদি) তাঁর স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন, “গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ। ঠিক হয়ে গেছে তাঁকে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হবে চিকিৎসার জন্য। ‘এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার’ গানটি গাইতে গাইতে উত্তরায়ণ প্রাঙ্গণে উপস্থিত আমরা। সমস্ত আশ্রমবাসীর চোখেমুখে ছিল উদ্বেগের ছায়া। গুরুদেব সুস্থ হয়ে ফিরে আসবেন তো? আমার মতন সবার মনেই এই প্রশ্ন বারবার ধাক্কা দিচ্ছিল। কলকাতায় গুরুদেবের চিকিৎসা চলছে। প্রতিদিন তাঁর খবরের অপেক্ষায় আমরা আশ্রমের সবাই বসে থাকতাম। ২২ শ্রাবণ। সেই নিদারুণ খবর এলো। গুরুদেব নেই। আশ্রমজুড়ে ঝড়ো হাওয়া এবং বৃষ্টি যেন সেদিন একটা কথাই বারবার বলে যাচ্ছে, নেই, নেই, নেই। আমিও ধীরে ধীরে বেরিয়ে গেলাম পুরোনো লাইব্রেরির (বর্তমান পাঠভবনের অফিস) দিকে। এখানে সবাই এসে জড়ো হচ্ছেন। সেদিন যেন প্রকৃতি আর মানুষ সবাই কাঁদছে। আমরা গাইলাম, ‘সমুখে শান্তি পারাবার’ গানটি। গাইলাম না কাঁদলাম, জানি না।’