দেশে প্রতিদিন প্রায় ২০০ শিশু হৃদ্রোগ নিয়ে জন্মায়

দেশে জম্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যে প্রতিদিন প্রায় ২০০ শিশু হৃদ্রোগ নিয়ে জন্ম নেয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আর বিশ্বজুড়ে নবজাতকের মৃত্যুর এক-চতুর্থাংশ হৃদ্রোগজনিত, আর বাংলাদেশেও নবজাতক নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি প্রায় ৩০ শতাংশ শিশুর মধ্যে হৃদ্রোগ শনাক্ত হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে প্রতিদিন প্রায় ৮ হাজার শিশুর জন্ম হয়, যার মধ্যে অন্তত ২০০ শিশু হৃদ্রোগ নিয়ে জন্ম নেয়। বছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৭৪ হাজারে।
গতকাল রোববার (২৮ সেপ্টেম্বর)‘বিশ্ব হার্ট ডে’ উপলক্ষ্যে রাজধানীর বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালে শিশু হৃদ্রোগ বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে বক্তারা এসব কথা বলেন।
অনুষ্ঠানটি যৌথভাবে আয়োজন করে কিডস হার্ট ফাউন্ডেশন, চাইল্ড হার্ট ট্রাস্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ হার্ট রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ সোসাইটি অফ অ্যাডাল্ট অ্যান্ড কনজেনিটাল হার্ট ডিজিজ।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন দেশবরেণ্য হৃদ্রোগ সার্জন অধ্যাপক ডা. এসআর খান। বিশেষ অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ হেলথ জার্নালিস্ট ফোরামের প্রেসিডেন্ট রাশেদ রাব্বি। দেশের শীর্ষস্থানীয় বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন।
মিট দ্য প্রেসে শুরুতে সভাপতির বক্তব্যে স্বাধীনতা পদকপ্রাপ্ত শিশু হৃদ্রোগ বিশেষজ্ঞ ও কিডস হার্ট ফাউন্ডেশনের সভাপতি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক ডা. নূরুন্নাহার ফাতেমা বলেন, বাংলাদেশে জন্মগত হৃদরোগের ভয়াবহতা দিন দিন বেড়ে চলেছে। প্রতিদিন প্রায় দুই শতাধিক শিশু হৃদ্রোগ নিয়ে জন্ম নিচ্ছে, বছরে এ সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ৭৪ হাজারে। এটি ডেঙ্গু বা কোভিডের মতো একটি মহামারি। তবু জাতীয় স্বাস্থ্য কর্মসূচিতে জন্মগত হৃদ্রোগ এখনও অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
শিশুদের সঠিক সময়ে শনাক্তকরণ ও চিকিৎসার জন্য অবকাঠামো এবং বিশেষজ্ঞদের সংখ্যা বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। প্রতিটি নবজাতককে প্রাথমিক পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করতে হবে, যাতে জটিলতা দেখা দেওয়ার আগে চিকিৎসা দেওয়া যায়।
তিনি বলেন, বিশেষজ্ঞের সংখ্যা ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাড়ানো না হলে শিশু হৃদ্রোগ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারা কঠিন হবে।
এ সময় তিনি জাতীয় কর্মসূচির ঘাটতির কথাও তুলে ধরেন। জন্মগত হৃদ্রোগকে এখনো শিশু রোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। যদিও আইএমসিআই শিশুদের রোগ শনাক্ত ও ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, হৃদ্রোগকে বাদ দিয়ে দেওয়ায় অনেক শিশু সময়মতো চিকিৎসা পাচ্ছে না। আমাদের দেশকে অবশ্যই একটি সমন্বিত ও দৃঢ় পেডিয়াট্রিক কার্ডিয়াক নীতি গ্রহণ করতে হবে, যাতে জন্মগত হৃদ্রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসা আরও কার্যকরভাবে করা যায়।
এসময় অধ্যাপক ডা. এসআর খান বলেন, ২০০০ সাল থেকে বিশ্ব হার্ট দিবসটি প্রতি বছর পালিত হয়ে আসছে। এই প্রতিরোধ নীতির কার্যকারিতা বোঝার জন্য একটি উদাহরণ দিতে পারেন: কিছু ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণে শিশুদের বাতজ্বরজনিত হৃদ্রোগ হতে পারে। এই ক্ষেত্রে মাত্র ২০ পয়সার সিরিন ট্যাবলেট দিয়েই রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব, অথচ একটি হার্ট ভালভ পরিবর্তন করতে খরচ পড়তে পারে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা। এই কারণেই আমরা বলি, প্রতিরোধই সবচেয়ে কার্যকর এবং সস্তা।
তিনি বলেন, হৃদ্রোগের প্রতিকার সম্ভব, তবে এর জন্য আমাদের জীবনযাত্রা নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। খাদ্যাভ্যাস, চলাফেরা, নিয়মিত এক্সারসাইজ, ধূমপান বর্জন, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করলে হার্টের ঝুঁকি অনেক কমবে। মানসিক চাপ এড়ানোও গুরুত্বপূর্ণ, যা নতুন বিয়ে, চাকরি বা পরিবেশ পরিবর্তনের মতো পরিস্থিতিতে বৃদ্ধি পেতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে একটি প্রধান ঝুঁকি হলো আত্মীয়-স্বজনের মধ্যে ঘনিষ্ঠ বিবাহ, যেমন চাচাতো বা মামাতো ভাই-বোনদের মধ্যে। এছাড়া চিকিৎসা না হওয়া উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, গর্ভাবস্থায় কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি এবং ভাইরাল রোগও হৃদরোগের কারণ হতে পারে। তবে এসবের প্রতিকারও সম্ভব।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের ডিরেক্টর অব মেডিক্যাল সার্ভিসেস অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ সাফি মজুমদার, জাতীয় হৃদ্রোগ ইনস্টিটিউটের প্রফেসর ডা. আবদুল্লাহ শাহরিয়ার, ইব্রাহিম কার্ডিয়াক হাসপাতালের প্রফেসর ডা. শাহিদুল ইসলাম, বিএমইউ-এর প্রফেসর ডা. তারিকুল ইসলাম, সিএমএইচ-এর প্রফেসর ডা. নাজমুল ইসলাম ভূঁইয়া, শিশু হাসপাতালের ডা. রেজওয়ানা রিমা ও বিশিষ্ট পেডিয়াট্রিক কার্ডিওলজিস্ট ডা. আবদুস সালাম।