গেটেবাত কেন হয়?

গাউটকে সাধারণ বাংলায় গেঁটে বাত বলে। বাতরোগের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক ধরনগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম। ১০০-এর বেশি বাতরোগ রয়েছে, যা অস্থিসন্ধি, মাংসপেশি এবং হাড়কে আক্রান্ত করে। সব বাতব্যথার মধ্যে প্রায় পাঁচ শতাংশ বাতব্যথার কারণ হলো গাউটজনিত বাতব্যথা।
প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে প্রায় ৮৪০ জন গাউট রোগে ভোগে। শিশু ও অল্প বয়স্কদের ক্ষেত্রে এটি তেমন একটা দেখা যায় না। প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষেরা,বিশেষ করে যাদের বয়স ৪০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে তারা মহিলাদের চেয়ে গাউট রোগে বেশি আক্রান্ত হয়। মেনোপজের আগে মহিলারা কদাচিৎ আক্রান্ত হয়। যেসব লোকের অঙ্গ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তাদের গাউট রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
কারণ
যাদের রক্তে ইউরিক এসিড বেড়ে যায় তারাই স্বভাবত এই বাতরোগে আক্রান্ত হয়। যারা বেশি প্রোটিন বা আমিষ জাতীয় খাবার খায় তাদের এই উপসর্গ বেশি দেখা দেয়। সেজন্য এটির কারণ হিসাবে আমিষের বিপাক বা পিউরিন মেটাবলিজমকে চিহ্নিত করা হয়।
জন্মগতভাবে ইউরিক এসিড বিপাকের জন্য এনজাইম ঘাটতি থাকলে প্রাইমারি গাউট হয়। তবে কোনো কারণে যদি এই এসিড তৈরি বেড়ে যায় বা কোনো ওষুধ এই এসিড হজমে বাধা সৃষ্টি করে, যার কারণে কিডনি নিঃসরণ ক্ষমতা হারায়, সে ক্ষেত্রে গাউট হতে পারে। এ ধরনের গাউটকে বলে সেকেন্ডারি গাউট। প্রাইমারি গাউট বংশগত, যদিও একই পরিবারের সবাই আক্রান্ত হয় না। এ রোগ হওয়ার জন্য কিছু পরিবেশগত কারণও দায়ী।
গাউট মূলত এক ধরনের সিনড্রোম, যা ইউরেট নামক একপ্রকার লবণদানা জমে অস্থিসন্ধিতে প্রদাহ সৃষ্টি করে। এটি শরীরের রক্তরসে অতিরিক্ত ইউরিক এসিডের উপস্থিতির ফলেই ঘটে থাকে। গাউট স্বল্পকালীন তীব্র প্রদাহ ও দীর্ঘমেয়াদি প্রদাহ এই দুই ধরনের হতে পারে। আবার যে কারণে রক্তের ইউরেট লবণ বেড়ে যায় তার জন্যও বিভিন্ন কারণ দায়ী। যেমন : ব্যক্তির খাদ্যাভ্যাস, পারিপার্শ্বিক বা পরিবেশগত কারণ এবং ব্যক্তির জন্মগত ত্রুটি।
মূলত গাউটের কারণ হলো রক্তে অতিরিক্ত ইউরিক এসিড বা ইউরেট লবণের উপস্থিতি। অতিরিক্ত ইউরিক এসিড শরীরে দুইভাবে জমতে পারে, যেমন-অতিরিক্ত ইউরিক এসিড উৎপাদন এবং ইউরিক এসিড শরীর থেকে বেরিয়ে যেতে বাধাপ্রাপ্ত হওয়া। ইউরিক এসিড শরীর থেকে সাধারণত কিডনির সাহায্যে বের হয়। কোনো কারণে বিশেষ করে কিডনির অসুখের জন্য কিডনির কার্যক্ষমতা কমে যায়।
রক্তে অতিরিক্ত ইউরিক এসিড কেন তৈরি হয়
বিভিন্ন কারণে রক্তে অতিরিক্ত ইউরিক এসিড তৈরি হয়। যেমন :
- বয়স বেশি হওয়া।
- বংশগত এনজাইমের ত্রুটি, হাইপার প্যারা থাইরয়েডিজম।
- রক্তের লোহিত কণিকা ভেঙে যাওয়াজনিত অস্বাভাবিকতা।
- দেহের অতিরিক্ত ওজন, ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ।
- প্রচুর লাল মাংস খাওয়া।
- রক্তে চর্বির মাত্রা বেড়ে যাওয়া।
- দীর্ঘস্থায়ী প্রদাহজনিত অসুখ।
- দীর্ঘ দিন ধরে অ্যাসপিরিন বা ডাইইরেটিকস ওষুধ গ্রহণ।
- অতিরিক্ত মদ্যপান।
- সোরিয়াসিস রোগ।
- সিসার বিষক্রিয়া।
- অতিরিক্ত ব্যায়াম।
- হঠাৎ করে বেশি পরিমাণে খাদ্যগ্রহণ কমিয়ে দেওয়া বা অভুক্ত থাকা।
রক্তের ইউরিক এসিড কমাতে কোন ধরনের খাবার বর্জন
রক্তের ইউরিক এসিড কমাতে পিউরিনসমৃদ্ধ খাবার পরিহার করবেন; যেমন :
- বিভিন্ন ধরনের ডাল বিশেষ করে মসুর ডাল ও মটর ডাল।
- শিম, শিমের বিচি, বরবটি, মটরশুঁটি, কড়াইশুঁটি ইত্যাদি।
- পুঁইশাক, পালং শাক, অ্যাসপ্যারাগাস, ফুলকপি, মাশরুম, ইস্ট ইত্যাদি।
- গরুর মাংস, খাসির মাংস, ভেড়ার মাংস, হরিণের মাংস, সব ধরনের হাঁসের মাংস যেমন- রাজহাঁস, জংলি হাঁস ও পাতিহাঁস; বাছুরের মাংস, শূকরের মাংস, খরগোসের মাংস, বড় পাখির বা তুর্কি মোরগের মাংস, কবুতরের মাংস, তিতির পাখির মাংস ইত্যাদি।
- মগজ, কলিজা, বৃক্ক, যকৃত, অগ্ন্যাশয়, জিহ্বা ইত্যাদি।
- বিভিন্ন সামুদ্রিক মাছ ও মাছের ডিম।
- ঝিনুক, কাঁকড়া, চিংড়ি, শামুক ইত্যাদি।
- মাংসের ঝোল, মুরগির স্যুপ, মাংস ও তরকারির স্যুপ ইত্যাদি।
গাউট রোগের উপসর্গ
গাউটের প্রধান উপসর্গ হলো পায়ের বুড়ো আঙুলে ব্যথাসহ শরীরের অন্যান্য অস্থিসন্ধিতে ব্যথা। এই ব্যথা সামান্য থেকে প্রচণ্ড ধরনের হতে পারে। কারো কারো ব্যথা এত তীব্র হয় যে,রোগী হাঁটাচলা করতে পারে না। ব্যথা সাধারণত প্রোটিন জাতীয় খাবার খেলে বেড়ে যায়।
- হঠাৎ তীব্র ব্যথা হয়, ব্যথার কারণে ঘুম ভেঙে যায়।
- পায়ের বুড়ো আঙুলের গোড়া ফুলে যায় ও লাল হয়।
- হাঁটু, কনুই বা অন্য যেকোনো অস্থিসন্ধি ফুলে যায়।
- সাধারণত একটি সন্ধিই আক্রান্ত হয়, তবে একাধিক অস্থিসন্ধিতেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।
- ক্রমান্বয়ে হাড় ও তরুণাস্থি ক্ষয় হতে থাকে।
- অস্থিসন্ধি তার স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা হারাতে থাকে।
রোগ নির্ণয়
সাধারণত রক্ত পরীক্ষা করে বিশেষ করে ইউরিক এসিডের মাত্রা দেখে গাউটের ধরন ও তীব্রতা বোঝা যায়। সাধারণভাবে ইউরিক এসিডের স্বাভাবিক মাত্রা হলো শতকরা ২-৬ মিলিগ্রাম। ৬ মিলিগ্রামের ওপরে গেলে গাউট সন্দেহ করতে হবে এবং তখনই চিকিৎসা করাতে হবে।
ইএসআর এবং শ্বেতকণিকার সামগ্রিক গণনা বেড়ে যাবে। আক্রান্ত অস্থিসন্ধি থেকে রস নিয়ে পরীক্ষা করলে ক্রিস্টাল বা দানা ধরা পড়বে। এক্স-রে করলে দীর্ঘস্থায়ী গাউটের ক্ষেত্রে হাড়ে ও অস্থিসন্ধিতে বিশেষ ধরনের ক্ষয় ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক পরিবর্তন দেখা দেবে।
এই রোগের বিশেষত্ব কী?
গাউটের বিশেষত্ব হলো-
- রক্তে ইউরিক এসিডের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি থাকে।
- প্রথম উপসর্গের মতো বারবার একইরকম লক্ষণ দেখা দেয়।
- অস্থিসন্ধিতে মনোসোডিয়াম ইউরেট মনোহাইড্রেট ক্রিস্টাল জমা হয়।
- দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে কার্টিলেজ বা তরুণাস্থি ক্ষয় হয়।
- কিডনির কার্যকারিতা লোপ পায় এবং কিউসিতে ইউরিক এসিড পাথর তৈরি হয়।
গাউটের ক্ষেত্রে কিছু কথা মনে রাখতে হবে। যেমন :
- কোনো অস্থিসন্ধিতে সামান্য আঘাতের পর যদি অতিরিক্ত ব্যথা অনুভূত হয়। সেটিকে গাউট ভাবতে হবে।
- স্বাভাবিক জীবনযাত্রার পরিবর্তনে বা কোনো ওষুধ গ্রহণে যদি বাতের উপসর্গের সৃষ্টি হয়, সেটিকে গাউট ভাবতে হবে।
- যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চিকিৎসা শুরু করতে হবে, না হলে বিভিন্ন জটিলতা দেখা দিতে পারে।
চিকিৎসা
প্রথমেই আক্রান্ত স্থানকে বিশ্রামে রাখতে হবে। ব্যথা ও প্রদাহের জন্য এনএসএ আইডি গ্রহণ করা যেতে পারে। এদের মধ্যে ইনডোমেথাসিন বেশ কার্যকর। গাউটের চিকিৎসায় একসময় কোলচিসিন খুব বেশি ব্যবহৃত হলেও দেখা গেছে তা কম কার্যকর এবং এটি ডায়রিয়া, বমিবমি ভাব ও বমি ঘটাতে পারে। অস্থিসন্ধি ফুলে গেলে সিরিঞ্জ দিয়ে রস টেনে বের করার প্রয়োজন হতে পারে এবং অস্থিসন্ধিতে কর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন দেওয়া যেতে পারে।
গাউটের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার জন্য অনেক ওষুধ থাকলেও অ্যালুপিউরিনল ওষুধটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়। এটি ইউরিক এসিডের মাত্রানুযায়ী দিতে হয়। এ ছাড়া রক্তের ইউরিক এসিড কমানোর জন্য ইউরিকোস ইউরিক ড্রাগ যেমন প্রোবেনাসিড বা সালফিপাইরাজোন ব্যবহার করা যেতে পারে। কখনোই টাইট জুতা পরবেন না। সতর্ক থাকবেন যাতে হাত-পায়ে কোনো আঘাত না লাগে। কারণ আঘাত লাগলে রোগের তীব্রতা বেড়ে যায়। এ ছাড়া খাদ্যের ব্যাপারেও সতর্ক হতে হবে। পিউরিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে হবে। গাউটের সমস্যা বেশি হলে অপারেশন প্রয়োজন হতে পারে।
লেখক : হাড়-জোড়া, বাত-ব্যথা ও আঘাতজনিত রোগ বিশেষজ্ঞ ও সার্জন।