সজলের জীবন থেকে ১০
আব্দুন নূর সজল এ সময়ের জনপ্রিয় অভিনেতা। প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে নাটকে অভিনয় করছেন তিনি। রোমান্টিক নাটকের পাশাপাশি অ্যাকশন, সামাজিক, থ্রিলার নাটকেও তিনি প্রাণবন্ত। আজ আমরা জানব সজলের জীবনের মজার ১০ ঘটনা।
শৈশবে সজলের ঈদ
ঈদ এলেই ভাইবোনদের সঙ্গে নিয়ে অনেক মজা করতেন সজল। ঈদের দিন দুপুর বেলা সজলের খালার বাসায় সবার দাওয়াত থাকত। কোনো ঈদেই এর ব্যতিক্রম হতো না। সজল তাঁর কাজিনদের নিয়ে ঈদের আগের দিন রাতে খালার বাসায় চলে যেতেন। তাঁর এক মামা ছিলেন যিনি সব সময় সবাইকে কড়া শাসনে রাখতেন। সজল ও তাঁর কাজিনরা খুব এলোমেলো ছিলেন। তাই মামা সব সময় তাদের দাঁত ব্রাশ ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে বলতেন। কিন্তু সজলরা সব ভাইবোন মিলে মামার সব আদেশ ভাঙতেন। সজলের দাবি, ‘ঈদে স্কুল ছুটি থাকত। সেই সময় আমরা সবাই স্বাধীন থাকতে চাইতাম তাই কোনো নিয়ম মানতে ইচ্ছে করত না।’ সজলের সেই কাজিনরা হলো ইতু, স্বর্ণা, সাগর, পাপ্পু এবং তাঁর বড় ভাই উজ্জ্বল। একবার ঈদের সালামি পেয়ে সবাই সেই টাকা দিয়ে কিছু খেলনা পিস্তল কিনেছিলেন। খেলনা পিস্তল দিয়ে রাতে সবাই ভূত সেজে তাঁদের সেই মামাকে ভয় দেখিয়েছিলেন।
পিস্তলের কাহিনী এখানেই শেষ নয়। একদিন সকালে পিস্তল নিয়ে সবাই যখন বাইরে বের হয়েছেন, ঠিক তখন এক রিকশাওয়ালা তাঁদের হাতের পিস্তল দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। শত চেষ্টা করেও সজলরা তাঁকে বোঝাতে পারেননি এটা নকল পিস্তল। এরপর সজল রিকশাওয়ালার কাছে গিয়ে বলেন, ‘ভাই, এই পিস্তলটা খেলনা, এটার দাম হলো ১০০ টাকা।’ এ ঘটনা থেকে বোঝা যায় শৈশব-কৈশোরেও দারুণ অভিনেতা ছিলেন সজল।
মায়ের বকুনি শোনা
আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর অনেক শখ ছিল সজলের। কিন্তু পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে ঘুড়ি ওড়াতে পারতেন না তিনি। কারণ তাঁর মা একদম নিষেধ করে দিয়েছিলেন কারো সঙ্গে মেশা যাবে না। কারণ তাঁর ধারণা ছিল, সজল ওই সব ছেলের সঙ্গে মিশলে শুদ্ধ ভাষা ভুলে যাবে। তাই নিজেদের পুরান ঢাকার বাসার ছাদে প্রায়ই সজল একা একা ঘুড়ি ওড়াতেন। কখনো ভাইকে নিয়েও খেলতেন। একবার তাঁর ভাইসহ বাসার কাউকে না জানিয়ে চুপিচুপি ঘুড়ি ওড়াতে শুরু করেন তিনি। ঠিক তখনই ঘুড়িটা একটা গাছে গিয়ে আটকে যায়। এর আগে ঘুড়িগুলো সব নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এটাই ছিল তাদের শেষ ঘুড়ি। তাই ঘুড়িটা গাছ থেকে নামিয়ে আনতে পাইপ বেয়ে দোতলা থেকে বাসার নিচে নেমেছিলেন তাঁরা দুই ভাই। কিন্তু বাসায় যখন ঢুকতে যাবেন, তখনই দেখতে পান বাসা ভেতর থেকে তালা দেওয়া। এই ঘটনা তাঁর মা জানতে পেয়ে দুই ভাইকে এমন পিটুনি দিয়েছিলেন সেই পিটুনির কথা এখনো ভুলতে পারেননি সজল। সজল বলেন, ‘আমি এই মাইর জীবনেও ভুলব না।’
কলেজজীবনে সজল
ঢাকা কলেজে পড়তেন সজল। তাঁরা মোট ২০ জন বন্ধু ছিলেন। ক্লাসে একদম মন বসত না সজলের। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে নীলক্ষেতে বইয়ের দোকানের পাশে সব বন্ধুদের নিয়ে আড্ডা দিতেন তিনি। ক্লাসের সময় শেষ করে বাসায় ফিরে খাওয়া-দাওয়া করে তারপর আবারও একই জায়গায় এসে আড্ডা দিতেন তাঁরা। তাঁদের সারা বেলা আড্ডা দেখে একটা সময় আশপাশের সবাই মিলে জায়গাটার নাম দেন ‘বেকার চত্বর’। নামটি বেশ উপভোগ করেছেন বলে জানান সজল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সজল
সজল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিবিএ পাস করেছেন। অনেকে ভুল করে ভাবেন তিনি নাট্যকলার ছাত্র ছিলেন। এ প্রসঙ্গে সজল বলেন, ‘এখানেই শেষ নয়, আমার উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে একটা গল্প আছে। এমন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় নেই যেখানে আমি ভর্তি পরীক্ষা দেইনি। রাজশাহী ছাড়া সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি পরীক্ষা দিই এবং সবগুলোতে টিকে যাই। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হই এবং ক্লাসও করতে শুরু করি। এরপর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলাফল যখন বের হলো তখন মা বলল, ওখানে ভর্তি হতে, কারণ বিবিএ তাঁদের পছন্দের বিষয় ছিল। এভাবে সেখানে ভর্তি হই। কিন্তু ততদিনে অর্থনীতির অনেক পরীক্ষাও আমি দিয়েছিলাম। আর জাহাঙ্গীরনগরে যেতে আমার খুব কষ্ট হতো। তাই প্রথম প্রথম যেতে আমার বিরক্ত লাগত। এত জ্যাম হতো যে আমার বাসা থেকে ভার্সিটি পৌঁছাতে দেড় ঘণ্টা সময় লাগত আবার বাসায় ফিরতেও দেরি হতো।’
লোকাল বাসে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতেন সজল। সেই সময়ের স্মৃতিচারণা করে সজল বলেন, ‘এত পরীক্ষা থাকত যে আমি বাসে পড়তে পড়তে ক্লাসে যেতাম। বাসে বিভিন্ন টাইপের মানুষ উঠত। কখনো কখনো দাঁড়িয়ে যেতে হতো। একবার বাসে বসে আমি পড়ছি, তখন দেখি একটা মুরগির বাচ্চা আমার খাতার ওপর এসে পড়ল। আমি তো অবাক, পরে দেখি আমার পাশে একজন অনেকগুলো মুরগি নিয়ে বসে আছেন। তিনি ছিলেন মুরগি বিক্রেতা।’ আর একটা ঘটনা বলি, ‘আমি বাসে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে ক্লাসে যাচ্ছি। হঠাৎ দেখি আমার গায়ে পানি। পরে খেয়াল করি বাসের ছাদে একজন মাছ বিক্রেতা উঠেছেন, তাঁর মাছের পানি ওপর থেকে এসে জানালার মধ্য দিয়ে আমার গায়ে পড়েছে। এরপর বন্ধুর হলে গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে ক্লাসে গিয়েছিলাম।’
ভালো ছাত্ররা বেঞ্চের প্রথম সারিতে বসে ক্লাস করবেন এটাই স্বাভাবিক কিন্তু সজল সব সময় পেছনে বসে ক্লাস করতেন। এর কারণ জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বলেন, ‘দুষ্টামি করতাম তাই পেছনে বসলে সুবিধা হতো। সারাক্ষণ কথা বলার অভ্যাস ছিল আমার। কিন্তু প্রায়ই শিক্ষকদের কাছে ধরা খেতাম। তাই আমি ক্লাসে না গেলেও, কেউ যদি দুষ্টামি করত, স্যার আমার নাম ধরে ডেকে আন্দাজে সবাইকে বকা দিতেন। আমাকে শিক্ষকরা পছন্দও করতেন, কারণ যখন যা আমাকে জিজ্ঞাসা করতেন, তখন সেটার সঠিক উত্তর আমি দিতে পারতাম।’
যেভাবে ‘ভার্জিন তাকদুম তাকদুম’ শো শুরু
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ‘ভার্জিন তাকদুম তাকদুম’ শো করার প্রস্তাব পান সজল। শোয়ের প্রযোজক জুবায়ের বাবু জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। একটা নবীনবরণ অনুষ্ঠানে সজলের পারফরম্যান্স দেখে তিনি মুগ্ধ হন এবং সজলকে সেই শোর উপস্থাপক হওয়ার অডিশনের জন্য বলেন। সজলও প্রস্তাবে রাজি হন, অডিশন দেন এবং টিকেও যান। সজল বলেন, ‘এই শো আমার জন্য ইতিহাস। কারণ আমার যাঁরা ভক্ত, তাঁরা এখনো এই শোয়ের কথা বলেন।’
প্রতিদিন ক্লাস শেষ করে ঢাকায় ফিরে এই শোয়ের শুটিং শেষ করে বাসায় ফিরতেন সজল। শো অন এয়ার হওয়ার পরও সজল এ ব্যাপারে বাসায় কিছু বলেননি। সজল বলেন, ১২ পর্ব অন এয়ারের পর বাসায় এমনিতেই সবাই জেনে গেল। কারণ বাবা-মাকে সবাই এসে বলত, ‘আপনার ছেলে তো ভালো শো করছে।’ এরপর বাসার সবাই আমাকে ডেকে বলল, ‘সজল, যাই করো না কেন, পড়াশোনা বাদ রেখে কিছু করা যাবে না।’
যখন শিক্ষক সজল
সজল শিক্ষকও ছিলেন। একটা কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতেন তিনি। এ প্রসঙ্গে সজল বলেন, ‘আমার দিনের হাতখরচের জন্য টাকা লাগত তাই কোচিং সেন্টারে ক্লাস নিতাম। বন্ধুরা মিলে এই টাকা দিয়ে ঢাকার সব নামিদামি রেস্টুরেন্টে খেতাম। সবাই মিলে সারাদিন ঘুরতাম।’
বিজ্ঞাপনে সজলের চুল নকল
কিউট শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপনের মডেল হয়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন সজল। মজার ব্যাপার হলো, বিজ্ঞাপনে সজলের চুল নকল ছিল। এই মজার তথ্য সজল নিজে ফাঁস করেন।
বন্ধুর বিয়েতে সজল
প্রায় সব বন্ধুর বিয়েতে সজল উপস্থিত ছিলেন। বছরখানেক আগে পুরান ঢাকার এক বন্ধুর বিয়েতে সজল ছিলেন। তখন সজল রীতিমতো তারকা। সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে বর-বউয়ের ছবি না তুলে ফটোগ্রাফাররা সজলের ছবি তুলতে শুরু করেন। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষ হলে যখন তাঁর বন্ধু, বিয়ের ছবি দেখেন তখন তো অবাক! কারণ অধিকাংশ ছবি সজলের।
এ প্রসঙ্গে সজল বলেন, ‘এই ঘটনা যদি কেউ না জানে, সেই ছবিগুলো দেখে অনেকে ভুল বুঝবে। চমকে উঠে বলবে, সজল বিয়ে করল কবে?’
সজলের বাসায় মাঝির উপহার
সজলের অনেক ভক্ত আছেন, যাঁরা সজলের বাসায় উপহার পাঠান। যেমন অনেক দিন আগে চট্টগ্রামে সমুদ্রপাড়ে নাটকের শুটিং করতে গিয়ে এক মাঝির সঙ্গে সজলের পরিচয় হয়। সজলকে দেখার পর মাঝি খুব খুশি হন। সজলকে জানান তিনি তাঁর প্রিয় অভিনেতা। এরপর প্রতিবছর সজলের বাসায় সেই মাঝি মাছ পাঠিয়ে দেন। বারবার সজল তাঁকে না করলেও কাজ হয়নি। মাঝি তাঁর প্রিয় শিল্পীর বাসায় মাছ পাঠিয়ে ছেড়েছেন।
টঙ দোকানের চা খান সজল
পুরান ঢাকায় সজলের বেড়ে ওঠা। সেই জায়গার প্রতি এখনো অনেক মায়া তাঁর। তাই এখনো রাতে শুটিং শেষ করে মাঝে মাঝে বন্ধুরা মিলে বুড়িগঙ্গার পাড়ে যান এবং সেখানকার টঙ দোকানে পুরোনো হিন্দি গান শোনার ফাঁকে ফাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে চা খেতে ভালোবাসেন সজল।