বিএফডিসি
ক্যামেরা ক্রয় ও প্রশিক্ষণ নিয়ে অভিযোগ

চলচ্চিত্র নির্মাণে একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি)। একসময় চলচ্চিত্র নির্মাণের সব সুযোগসুবিধা নিয়ে এখানে তৈরি হয়েছে বহু বিখ্যাত ছবি। আর এখন চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চাইলে এফডিসি থেকে সে রকম কোনো সুযোগই পাওয়া যায় না, তাই সুবিধাবঞ্চিত হচ্ছেন নির্মাতারা। যেমন প্রয়োজনে ক্যামেরা না পাওয়া এবং এই ক্যামেরা সংকট কৃত্রিম বলেই মনে করছেন অনেক নির্মাতা।
পরিচালক বদিউল আলম খোকন বলেন ‘এফডিসিতে যে ক্যামেরা নেই বা সব ক্যামেরা ব্যস্ত তা নয়। কিন্তু আমার মতো পরিচালকই ক্যামেরা পায় না। আর যাঁরা নতুন কাজ করছেন, তাঁদের সঙ্গে কি হচ্ছে সহজেই অনুমান করা যায়।’
এফডিসিতে এখন তিনটি সনি এফ ৫৫ ক্যামেরা আছে। এর মধ্যে একটি নষ্ট আর বাকি দুটি যেন ভাড়া না দেওয়া যায় সে জন্য তৈরি হয়েছে নানা নিয়ম। অভিযোগ রয়েছে, নির্মাতাদের বাইরের হাউস থেকে ক্যামেরা ভাড়া করার জন্য রেফার করে দেওয়া হয় এফডিসির ভেতর থেকে। এবং এ জন্য ওই বাইরের হাউস থেকে কমিশনে অর্থ পান কর্মকর্তারা।
এ প্রসঙ্গে পরিচালক বদিউল আলম খোকন অভিযোগ করে বলেন, ‘বুঝতেই পারছেন একটা বিষয় তো এখানে আছেই। তা না হলে বাইরের ক্যামেরা দিয়ে কাজ করানোর প্রতি তারা আগ্রহ দেখাবে কেন? তা ছাড়া, এফডিসির ক্যামেরা না নিয়ে বাইরে থেকে ক্যামেরা নিলে এই কর্মকর্তাদের কী লাভ? এগুলো ভেবে দেখার দরকার আছে।’
এফডিসির ক্যামেরা ব্যবহার করলে বাংলাদেশেই শুটিং শেষ করতে হয়। দেশের বাইরে ক্যামেরা নিয়ে শুটিং করার কোনো নিয়ম নেই। আর বর্তমানে প্রায় সব ছবির শুটিং দেশের বাইরেই হয়, সুতরাং বাইরের হাউস থেকে ক্যামেরা নিতে হয় বাধ্য হয়ে। বাইরে থেকে ক্যামেরা ভাড়া নিতেও অনেক দুর্ভোগ পোহাতে হয় নির্মাতাদের। কদিন আগে পরিচালক বদিউল আলম খোকন তার ‘রাজাবাবু’ ছবির জন্য ক্যামেরা নিতে চাইলেও ক্যামেরা পাননি, কারণ এই ছবির গানের শুটিং হবে দেশের বাইরে। যেখানে সারা পৃথিবীর সঙ্গে আমাদের চলচ্চিত্রের প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে, সেখানে এফডিসির ক্যামেরা নিয়ে দেশের বাইরে শুটিং করা যাবে না, এফডিসির এমন সিদ্ধান্ত যুগোপযোগী নয় বলেই মত নির্মাতাদের।
পরিচালক খোকন বলেন, ‘বাইরে থেকে ক্যামেরা নিলে আমাদের খরচ বেড়ে যায়। বাইরের হাউসের একটা ক্যামেরা থাকলে তো কথাই নেই। কোনো ঝামেলা হলে আমাদের শুটিং প্যাক আপ করতে হয়। দেশের বাইরে যদি আমরা শুটিং না করি, তাহলে ছবির মান সব সময় ধরে রাখা যায় না। শুধু যে গানের শুটিং করতে বাইরে যাই তা তো নয়, গল্পের প্রয়োজনেও বাইরে শুটিং করতে হয়। এফডিসি থেকে ক্যামেরা নিলে আমাদের গল্প বদলাতে হয়।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের পরিচালক লক্ষ্মণচন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘আমাদের ক্যামেরা কম তাই আসলে আমরা আমাদের ক্যামেরা না নিয়ে বাইরের ক্যামেরা নিয়ে কাজ করার উৎসাহ দিচ্ছি। বাইরের হাউসগুলোর সঙ্গে আমাদের কোনো অর্থ লেনদেনের সম্পর্ক নেই।
প্রশাসনিক অদক্ষতা এবং কতিপয় কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে এফডিসির অনেক কলাকুশলী-কর্মচারীই অসন্তুষ্ট। এখনই এফডিসিকে দুর্নীতিমুক্ত ও সংস্কার না করলে এই প্রতিষ্ঠান একসময় জাদুঘরে পরিণত হবে বলে আশঙ্কা অনেকের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ক্যামেরা সহকারী বলেন, ‘এখানে কাজ করে আমাদের পেট চলে, আর কিছু কর্মকর্তার কারণে সব থেকেও নেই। আমাদের বাইরে যেতে দিচ্ছে না। কেন দিচ্ছে না আমরা সবই জানি। কিন্তু কিছু বললে চাকরি চলে যাবে। এফডিসিকে জাদুঘর বানাবে, এখানে কেউ কাজ করার সাহস পাবে না সামনে।’
গত বছর এফডিসির জন্য পাঁচটি ক্যামেরা ক্রয়ের সিদ্ধান্ত হয়। পাঁচটি ক্যামেরার মধ্যে তিনটি ‘রেড ক্যামেরা’ ও দুটি ‘অ্যারি অ্যালেক্সা’ ক্যামেরা আনার জন্য বিএফডিসির সব স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও কলাকুশলীরা স্পেসিফিকেশন থেকে শুরু করে দরপত্র কমিটি, মূল্যায়ন কমিটির প্রায় সবাই উল্লিখিত ক্যামেরা আনার জন্য জোর অনুরোধ জানালেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে সেগুলো আনা হয়নি। বরং ‘অ্যারি অ্যালেক্সা’ ক্যামেরা বাদ দিয়ে সনি এফ ৫৫ ক্যামেরা ক্রয় করার জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়। বিএফডিসির স্বার্থে এবং উৎপাদনের কথা বিবেচনা করে দুটি ‘অ্যারি অ্যালেক্সা’ ক্যামেরা ক্রয় করার জন্য প্রকল্প পরিচালককে বারবার লিখিত ও মৌখিক তাগাদা দেওয়া সত্ত্বেও তিনি এ বিষয়ে কোনো প্রকার কর্ণপাত না করে সনি এফ ৫৫ ক্যামেরা নিয়ে আসেন। কিন্তু ক্যামেরা খুলে দেখা যায় মেড বক্স, ট্রাইপড, লেন্স বক্স, সবই নকল। এমনটাই জানালেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মচারী।
পরিচালক শাফি উদ্দিন শাফি বলেন, ‘যে ট্রাইপড আনা হয়েছে সেটি দিয়ে কাজই করা যায় না। এই ট্রাইপড দিয়ে ফিক্সড শট ছাড়া অন্য কোনো শট নেওয়া যায় না। প্যানশট নেওয়ার সময় ক্যামেরা কাঁপে। ট্রলিতেও এই ট্রাইপড দিয়ে কাজ করা যায় না।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের পরিচালক লক্ষ্মণচন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘বিষয়টি আসলে এমন নয়। আমাদের বাজেট কম তাই এই ক্যামেরা আনতে হয়েছে, এখানে আর কোনো বিষয় নেই।’ নকল ট্রাইপড ও লেন্স বক্স সম্পর্কে দেবনাথ বলেন, ‘এগুলো নকল থাকলে আমাদের আগে বলেনি কেন? এতদিন পর এসব বলে লাভ কি? তা ছাড়া আমরা তো আসলে জানি না কোনটা ভালো।’
যে কোনো যন্ত্রাদি, যেমন ক্যামেরা বা এডিটিং প্যানেল ক্রয়ের পর সেসব যন্ত্র পরিচালনার জন্য একটি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে কর্তৃপক্ষ। এখানেও রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ। সম্প্রতি সনি ক্যামেরা কেনার পর ভারত থেকে উচ্চ মূল্যে প্রশিক্ষক আনা হয়। এবং এই প্রশিক্ষণে অংশ নেন এফডিসির প্রথম সারির দুজন কর্মকর্তা, আর কেউ নন। অথচ তাঁরা ক্যামেরা পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত নন। যাঁরা ক্যামেরা ব্যবহার করেন, তাঁদের প্রশিক্ষণের সুযোগ না দেওয়ায় এই দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন ক্যামেরা সহকারী বলেন ‘এখানে আমাদের ট্রেনিংয়ের জন্য প্রায় ৩০ লাখ টাকা বাজেট ছিল। টাকা বাঁচাতে আমাদের ট্রেনিং না করিয়ে দুজন কর্মকর্তাকে দিয়ে ট্রেনিং করানো হয়েছে। আবার তাঁরা আমাদের ট্রেনিং করিয়েছেন। এখানে টাকা মেরে খাওয়াই উদ্দেশ্য ছিল।’
এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রশাসন ও অর্থ বিভাগের পরিচালক লক্ষ্মণচন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা, আমরা দুজন অফিসারকে ট্রেনিং করিয়ে এনেছি। পরবর্তী সময়ে তাঁরাই আমাদের ছেলেদের ট্রেনিং করিয়েছেন।’
এফডিসির মতো ঐতিহ্যবাহী সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্বচ্ছতা থাকা একান্ত প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। এই প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে এখনই সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়া দরকার বলেও মনে করেন তাঁরা।