পুলিশ চিকিৎসায় বাধা দেয়, যুবলীগ-ছাত্রলীগ হাসপাতাল অবরোধ করে

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হামলার ঘটনায় করা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আজ ডা. হাসানুল বান্নাসহ চারজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এদিন সাক্ষী ইবনে সিনার ডা. হাসানুল বান্না বলেন, ২০২৪ সালের ১৮ জুলাই দুপুরে আমাদের হাসপাতালে অসংখ্য আহত এলে আমরা চিকিৎসা শুরু করি, যাদের মধ্যে অনেকের অপারেশন করা লেগেছে। ওইদিন সন্ধ্যার পরে পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হাসপাতালে এসে চিকিৎসা প্রদানে বাধা প্রদান করে এবং রোগী ভর্তি করতে নিষেধ করে। তারা রোগীর ভর্তি রেজিস্ট্রার চেক করে এবং রোগীদের তালিকা নিয়ে যায়। ওই বছরের ১৯ জুলাই সকাল থেকে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় সন্ত্রাসীরা হাসপাতালের গেট অবরোধ করে চেয়ার নিয়ে সারা দিন বসে ছিল। কোনো রোগী হাসপাতালে ঢুকতে দেয়নি তারা।
আজ বুধবার (২০ আগস্ট) বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষীর জবানবন্দি দেন ডা. হাসানুল বান্না। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন—বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আজ পর্যন্ত এ মামলায় ১৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে।
ট্রাইব্যুনালে দেওয়া জবানবন্দিতে সাক্ষী বলেন, ‘আমার নাম ডা. হাসানুল বান্না। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৪৩ বছর। আমি ইবনে সিনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কল্যাণপুরে ২০১৯ সাল থেকে সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত আছি।’
‘২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লব চলাকালে ১৮, ১৯ ও ২০ জুলাই এবং আগস্টের ২, ৩, ৪ ও ৫ তারিখ ও তৎপরবর্তী সময়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলিবিদ্ধ অসংখ্য ছাত্র-জনতাকে চিকিৎসা প্রদান করেছি’, যোগ করেন ডা. হাসানুল বান্না।
সাক্ষী ডা. হাসানুল বান্না বলেন, ‘১৮ জুলাই দুপুরের পর থেকে আমাদের হাসপাতালে অসংখ্য আহত ব্যক্তি এলে আমরা চিকিৎসা প্রদান শুরু করি, যাদের মধ্যে অনেকের অপারেশন করা লেগেছে। ১৮ জুলাই সন্ধ্যার পরে পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা হাসপাতালে এসে চিকিৎসা প্রদানে বাধা প্রদান করে এবং রোগী ভর্তি করতে নিষেধ করে। রোগীর ভর্তি রেজিস্ট্রার চেক করে এবং রোগীদের তালিকা নিয়ে যায়। ১৯ জুলাই সকাল থেকে যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের স্থানীয় সন্ত্রাসীরা হাসপাতালের গেট অবরোধ করে চেয়ার নিয়ে সারা দিন বসে ছিল।’
ডা. হাসানুল বান্না আরও বলেন, ‘কোনো রোগী হাসপাতালে ঢুকতে দেয়নি আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। সেদিন তারা হাসপাতালে কোনো অ্যাম্বুলেন্স ঢুকতে দেয়নি এবং বের হতেও দেয়নি। আমাদের হাসপাতালের টেকনোলোজিস্ট মিতুর স্বামী মোস্তাকিন বিল্লাহ, যিনি ইনোভা ডায়াগোনেস্টিক সেন্টারে টেকনোলোজিস্ট ছিলেন, মিরপুর ১০নং গোল চত্ত্বরে মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। তাকে বিকল্প পথে আমাদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার জরুরি অপারেশনের প্রয়োজনে নিউরো সার্জন আনার জন্য অ্যাম্বুলেন্স পাঠানোর প্রয়োজন হলেও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা অ্যাম্বুলেন্স বের হতে দেয়নি; পরবর্তীতে তাকে বিকল্প পথে নিউরো সায়েন্স হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে তাকে ভর্তি না নেওয়া হলে তাকে ইবনে সিনা হাসপাতালের ধানমণ্ডি শাখায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত ডাক্তার তাকে মৃত ঘোষণা করেন।’
ডা. হাসানুল বান্না সাক্ষীর জবানবন্দিতে বলেন, ‘১৮ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হাসপাতালে আগত গুলিবিদ্ধ রোগীদেরকে ভিন্ন নামে এবং ভিন্ন রোগ উল্লেখ করে লুকিয়ে রেখে গোপনে পুলিশের নজরদারি এড়িয়ে সাধারণ ওয়ার্ডে না রেখে পোস্ট অপারেটিভ, আইসিইউ, বিশেষ কেবিনে রেখে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চিকিৎসা প্রদান করি। এসব ঘটনার জন্য আমি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলকসহ আওয়ামী নেতারা এবং পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দায়ী বলে মনে করি। আমি একজন চিকিৎসক হিসেবে এ ঘটনার সুষ্ঠু ও ন্যয়বিচার প্রত্যাশা করি। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এই হলো আমার জবানবন্দি।’