আন্দোলনে গিয়ে গুলিতে ছেলে হারানো মায়ের মর্মস্পর্শী বর্ণনা

জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হামলার ঘটনায় করা মামলায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে আজও চারজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এদের মধ্যে ১৪ বছর বয়সী শহীদ মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা সোনিয়া জামাল আদালতকে বলেন, ‘২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আমার ছেলে আমাকে বলে আন্দোলনে যায়। আমি মেয়েকে নিয়ে আন্দোলনে যোগদান করি। দুপুরের দিকে খবর পাই ছেলে আহত হয়েছে। বাসায় ফিরে দেখি ছেলে গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছে। চোখের বাম পাশে গুলি লেগে মাথার পেছন দিয়ে বড় গর্ত হয়ে বেরিয়ে গেছে। অনেক রক্ত বের হচ্ছিল, তা দেখে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি।’
এভাবেই ওইদিনের মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরে ট্রাইব্যুনালে কান্নায় ভেঙে পড়েন সাক্ষী সোনিয়া জামাল। আজ বুধবার (২০ আগস্ট) বিচারপতি গোলাম মর্তুজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের ট্রাইব্যুনাল-১ এ সাক্ষীর জবানবন্দি দেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন—বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। আজ পর্যন্ত এ মামলায় ১৬ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণ ও জেরা শেষ হয়েছে।
জবানবন্দিতে সাক্ষী বলেন, ‘আমার নাম সোনিয়া জামাল। আমার বর্তমান বয়স আনুমানিক ৪১ বছর। আমি একজন গৃহিণী। আমি জুলাই আন্দোলনে শহীদ হওয়া মেহেদী হাসান জুনায়েদের মা। আমার ছেলে গেন্ডারিয়া উইল পাওয়ার স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র ছিল। তার বয়স ছিল ১৪। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট চানখারপুলে আমার ছেলে নিহত হয়। আমার ছেলে ১০ পারা কোরআন হিফজ (মুখস্থ) করেছিল। ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত আমার ছেলে নিয়মিত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগদান করত, যা আমি জানতাম না।’
শহীদ জুনায়েদের মা আরও বলেন, ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আমি নিজেও অংশগহণ করি। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সকাল সাড়ে ১০টার সময় আমার ছেলে নাশতা করার পর আমাকে বলে, মা আমি আমার বন্ধু সিয়ামকে নিয়ে আন্দোলনে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমি আমার মেয়ে নাফিসা নাওয়ালকে সঙ্গে নিয়ে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে আন্দোলনে যোগদান করার জন্য রওনা দেই। পথিমধ্যে পুলিশ আমাকে কোথায় যাই জিজ্ঞাস করে, তখন আমি বলি—আমার আত্মীয় মারা গেছে, আমি সেখানে যাব। তখন তারা আমাকে যেতে দেয়।’
আন্দোলনে নিজের অবদানের কথা তুলে ধরে জুলাই শহীদের এই মা সোনিয়া জামাল বলেন, ‘আইডিয়াল স্কুলের কাছাকাছি পৌঁছলে পুলিশ আমার রিকশা থামিয়ে দেয়। রিকশা থেকে নেমে আমি আমার মেয়েকে নিয়ে পায়ে হেঁটে আন্দোলনে অংশগ্রহণ করি আনুমানিক ১২টার সময়। আনুমানিক এক ঘণ্টা পর মোবাইলফোন চেক করে দেখি অনেকগুলো কল এসেছে। কলগুলো ছিল আমার ছোট ভাই আসিফের। এরপর আসিফ আবার আমাকে ফোন করে তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলে।’
‘সে বলে জুনায়েদ মাথায় ব্যথা পেয়েছে। তখন আমি আমার মেয়েকে নিয়ে বাসায় চলে আসি। আমি আমার ভাসুরের কক্ষে ঢুকে দেখি, আমার ছেলেকে বিছানায় শুইয়ে রাখা হয়েছে। তার চোখের বাম পাশে গুলি লেগে মাথার পেছন দিয়ে বড় গর্ত করে বেরিয়ে গেছে। অনেক রক্ত বের হচ্ছিল, তা দেখে আমি কান্নায় ভেঙে পড়ি’, কথাগুলো আদালতে বলতে বলতে সাক্ষী সোনিয়া জামাল অঝোরে কাঁদতে থাকেন।
শহীদ জুনায়েদের মা আরও বলেন, ‘আমি জানতে পারি, ঐ দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বার্ন ইনস্টিটিউটের (জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট) অপর পাশে ফুটপাতে জুনায়েদ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়। তার বন্ধু সিয়াম ও আব্দুর রউফ তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত ডাক্তার বলেন, সে আগেই মারা গেছে। তারা আমার ছেলের লাশ বাসায় নিয়ে আসে। এরপর তার লাশ ধুপখোলা মাঠে জানাজার জন্য নেওয়া হয়। আমি আমার স্বামীর কাছে জেনেছি, সেখানে শাহরিয়ার খান আনাস নামের আরেকজন শহীদের জানাজা হয়েছে। আমার ছেলে (মেহেদী হাসান জুনায়েদ) ও তাকে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয়।’
সাক্ষীর জবানবন্দিতে সোনিয়া জামাল বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জানতে পারি— চানখারপুলের নবাব কাটরা সংলগ্ন এলাকায় পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান, যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার ও এডিসি আক্তারুল ইসলামের নির্দেশে কনস্টেবল সুজন, ইমাজ, নাসিরুল বেপরোয়াভাবে গুলি চালিয়ে আমার ছেলে মেহেদী হাসান জুনায়েদ, শাহরিয়ার খান আনাস, ইয়াকুব, রাকিব হাওলাদার, ইমতিয়াজ ও মানিককে হত্যা করে। আমি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আরও জানতে পারি—এই হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্টমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন।’
‘মোবাইলে (সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে) দেখেছি, একজন পুলিশ গুলি করার ভিডিও তখনকার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকে দেখাচ্ছেন এবং বলছেন—স্যার গুলি করি, মরে একজন, বাকিরা যায় না’, কথাগুলো বলতে গিয়ে শহীদ জুনায়েদের মা সোনিয়া জামাল আবারও কাঁদতে থাকেন।
সোনিয়া জামাল আরও বলেন, ‘আমার সন্তানকে গুলি করার একটি ভিডিও আব্দুর রউফ আমাকে দিয়েছে। ভিডিও সম্বলিত একটি পেনড্রাইভ ট্রাইব্যুনালে দাখিল করলাম। এই সেই ভিডিও সম্বলিত পেনড্রাইভ (বস্তু প্রদর্শনী-X)। তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। এই আমার জবানবন্দি।’ এরপর ভিডিওটি ট্রাইব্যুনালে প্রদর্শন করা হয়। সেখানে জুনায়েদের লাশ সাক্ষী শনাক্ত করেন। জুনায়েদের লাশের বাম চোখে রক্তাক্ত ব্যান্ডেজ দেখা যায়।