কী আছে ট্রাম্পের নতুন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে, বন্ধ হবে কি গাজা যুদ্ধ?

সাম্প্রতিক দিনগুলোতে গাজায় যুদ্ধবিরতির আলোচনা জোরদার হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে জানিয়েছিলেন, ইসরায়েল ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে। এর ফলে গাজায় ইসরায়েলের প্রায় ২১ মাস ধরে চলা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে আলোচনার জন্য মধ্যস্থতাকারীরা বৈঠক করতে পারেন।
হামাস জানিয়েছে, তারা কিছু সংশোধনীসহ মধ্যস্থতাকারীদের প্রস্তাবের প্রতি ‘ইতিবাচক সাড়া’ দিয়েছে। অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীটির দাবিগুলোকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলেছেন। তবে, এরপরও তিনি আলোচনার জন্য দোহায় আলোচকদের পাঠিয়েছেন।
নেতানিয়াহু আজ সোমবার (৭ জুলাই) ওয়াশিংটন ডিসি সফরে যাচ্ছেন, খবর অনুযায়ী ট্রাম্প একটি চুক্তি চাইছেন। ট্রাম্প গত শনিবার (৫ জুলাই) সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আগামী সপ্তাহে একটি গাজা চুক্তি হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, হামাসের পাল্টা প্রস্তাব সম্পর্কে তাকে এখনও জানানো হয়নি, তবে তারা যে সাড়া দিয়েছে তা ‘ভালো’।
হামাস কী চাইছে?
বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, হামাসের তিনটি প্রধান দাবি হলো :
১। গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) বন্ধ করা : সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে গাজার জিএইচএফ সাইটগুলোতে সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে কমপক্ষে ৭৪৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। জুনের শেষের দিকে, হারেৎজ সংবাদপত্র জানায়, ইসরায়েলি সৈন্যদের ইচ্ছে করে খাবারের জন্য অপেক্ষারত নিরস্ত্র মানুষদের ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।
মানবতাবাদীরা বারবার বলেছেন, তারা গাজার ফিলিস্তিনিদের সাহায্য ও খাবার দিতে সক্ষম। তারা ইসরায়েলের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য জিএইচএফ-এর সমালোচনা করেছেন। জাতিসংঘের প্রধান মানবতাবাদী টম ফ্লেচার মে মাসে বলেছিলেন, ‘এটি সাহায্যকে রাজনৈতিক ও সামরিক লক্ষ্যের ওপর নির্ভরশীল করে তোলে। এটি অনাহারকে দর কষাকষির হাতিয়ার বানায়। এটা একটা নিন্দনীয় বিষয়... আরও সহিংসতা ও বাস্তুচ্যুতির জন্য এটি একটি অজুহাত।’
২। ইসরায়েলি সামরিক প্রত্যাহার : হামাস চায়, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এই বছরের মার্চ মাসে যুদ্ধবিরতি ভাঙার আগে যে অবস্থানে ছিল, সেখানে ফিরে যাক। মে মাসে, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গাজায় নতুন করে বড় ধরনের স্থল অভিযান শুরু করে। এতে উপত্যকার বিশাল অংশের ‘নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার’ জন্য শত শত ফিলিস্তিনি নিহত হয়। যুদ্ধ শুরুর পরপরই ইসরায়েলি সেনাবাহিনী নেজারিম করিডোর তৈরি করে, যা গাজা উপত্যকাকে উত্তর ও দক্ষিণ ভাগে ভাগ করে। এপ্রিল মাসে নেতানিয়াহু দক্ষিণ গাজা উপত্যকায় মোরাগ করিডোর তৈরির ঘোষণা দেন।
মার্কিন-সমর্থিত মূল প্রস্তাবে কী বলা হয়েছে?
এই চুক্তির মূল লক্ষ্য হলো- গাজায় আটক থাকা ইসরায়েলি বন্দীদের মুক্তি।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, হামাসের হাতে বন্দি ১০ জন জীবিত ইসরায়েলি ও আরও ১৮ জনের মৃতদেহ ইসরায়েলি কারাগারে বন্দী ফিলিস্তিনিদের বিনিময়ে মুক্তি দেওয়া হবে। এই মুক্তি কয়েক দিনে ধাপে ধাপে সম্পন্ন হবে। বর্তমানে গাজায় প্রায় ৫০ জন বন্দি আছে, যার মধ্যে প্রায় ২০ জন জীবিত আছে বলে জানা গেছে।
সাহায্যের বিষয়ে জাতিসংঘ ও রেড ক্রসের আন্তর্জাতিক কমিটি ফিলিস্তিনিদের কাছে পর্যাপ্ত খাবার ও সাহায্য বিতরণে সহযোগিতা করবে।
সবশেষে, এই প্রস্তাব গাজার কিছু অংশ থেকে ইসরায়েলি সেনাদের ধাপে ধাপে সরে আসার আহ্বান জানিয়েছে।
কী বলছে ইসরায়েল?
নেতানিয়াহু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন বলে জানা গেছে, কিন্তু হামাসের সংশোধনীগুলোকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ বলেছেন। তিনি বলেছেন, সব বন্দি মুক্তি না পেলে ও হামাসকে ‘ধ্বংস’ না করা পর্যন্ত তিনি যুদ্ধ শেষ করবেন না। অনেক বিশ্লেষক এই লক্ষ্যকে অসম্ভব বলে মনে করেন। এটি নেতানিয়াহুর ব্যক্তিগত স্বার্থ রক্ষার জন্য যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার একটি অজুহাত হিসেবে দেখা হচ্ছে।
নেতানিয়াহু দুর্নীতির অভিযোগে বিচারের মুখোমুখি। ইসরায়েলে এখনও অনেকে মনে করেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আল-আকসা ফ্লাড অভিযানের ফলে যে নিরাপত্তা ব্যর্থতা হয়েছিল, তার জন্য নেতানিয়াহুই দায়ী। ওই অভিযানে ইসরায়েলে এক হাজার ১৩৯ জন মারা যান ও প্রায় ২৫০ জনকে বন্দি করা হয়।
বিশ্লেষকরা মনে করেন, নেতানিয়াহু গাজার বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক যুদ্ধ চালিয়ে যেতে চান, যতক্ষণ না তিনি তার বিরুদ্ধে মামলা বাতিল করার জন্য যথেষ্ট রাজনৈতিক প্রভাব ও ইসরায়েলের নেতা থাকার জন্য প্রয়োজনীয় জনসমর্থন অর্জন করতে পারেন।

নেতানিয়াহুর এই যুদ্ধকে তার কট্টর ডানপন্থী মন্ত্রীরা, বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন গভির ও অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ সমর্থন করেছেন। তারা চান, ইসরায়েলের সামরিক অভিযান আরও তীব্র করা হোক, যাতে আরও ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা যায় এবং গাজার অবরুদ্ধ ও ক্ষুধার্ত মানুষকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করা যায়।
চুক্তিতে পৌঁছানোর সম্ভাবনা কতটুকু?
ট্রাম্প একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে আগ্রহী বলে মনে হচ্ছে। গাজার ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলি হামলা বন্ধের জন্য মরিয়া।
তবে, একটি বড় বাধা এখনও রয়ে গেছে। কাতার বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক আদনান হায়াজনেহ আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘ইসরায়েল ও নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতিতে পৌঁছাতে আগ্রহী নয়।’ তার মতে, যুদ্ধবিরতির ‘খুবই কম সম্ভাবনা’ রয়েছে।
হায়াজনেহ আরও বলেন, ‘ইসরায়েল যা চায় তা স্পষ্ট... একটি জনগণবিহীন ভূমি। তাই ফিলিস্তিনিদের তিনটি বিকল্প দেওয়া হয়েছে... অনাহারে মারা যাওয়া... নিহত হওয়া... অথবা ভূমি ছেড়ে যাওয়া। কিন্তু ফিলিস্তিনিরা এখনও প্রমাণ করেছে, যাই হোক না কেন, তারা ভূমি ছেড়ে যাবে না।’