যে কারণে দীর্ঘায়িত হয়নি ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন শনিবার (২১ জুন) রাতে ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে চলা যুদ্ধে প্রবেশ করেন, তখন পুরো অঞ্চলটিতে চরম উত্তেজনা ছিল। ১৩ জুন থেকে ইসরায়েল ও তেহরানের মধ্যে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চলছিল। এই পরিস্থিতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে সহায়তা করতে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা নাতানজ, ফোরদো ও ইসফাহানে ১৭টি ম্যাসিভ অর্ডন্যান্স পেনিট্রেটর বোমা এবং দুই ডজন ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
ইরানের প্রতিক্রিয়া দ্রুত আসে। সোমবার (২৩ জুন) সন্ধ্যায়, তারা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন বিমান বাহিনীর কেন্দ্রীয় কমান্ড কাতারের আল উদেইদ ঘাঁটি লক্ষ্য করে ১৪টি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এই ক্ষেপণাস্ত্রগুলো নিরপেক্ষ দেশ কাতারের রাজধানী দোহার উপর দিয়ে উড়ে যায়, যা ব্যাপক উদ্বেগ সৃষ্টি করে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ‘প্রতিশোধের গর্ত’ তৈরির বিরুদ্ধে সতর্ক করার পরিবর্তে এই আক্রমণটি একটি যুদ্ধবিরতির পূর্বাভাস দেয়। ট্রাম্প কয়েক ঘণ্টা পরেই এই যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেন। যা কাতার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের মধ্যে অত্যন্ত জটিল কূটনীতির মাধ্যমে সম্ভব হয়েছিল।
তাহলে, এই আক্রমণ থেকে কীভাবে যুদ্ধবিরতি এলো?
ইরানের হাতে কী বিকল্প ছিল?
মার্কিন ঘাঁটির বিরুদ্ধে সামরিক প্রতিক্রিয়া ইরানের জন্য একটি স্পষ্ট বিকল্প ছিল, কারণ ইরানের আশেপাশে আমেরিকার ব্যাপক সামরিক উপস্থিতি রয়েছে।
আল উদেইদ বিমানঘাঁটি ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঞ্চম নৌবহরের সদর দপ্তর বাহরাইনে অবস্থিত। এই দুটি ঘাঁটি ইরান থেকে পারস্য উপসাগর জুড়ে মাত্র ২০০ কিলোমিটার (১২৫ মাইল) দূরে। কুয়েতে একটি বিমান ঘাঁটি ও ওমানে চারটি লজিস্টিক বিমান ঘাঁটি রয়েছে। আরও দূরে সৌদি আরবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বিমান ঘাঁটি, ইরাকে তিনটি বিমান ঘাঁটি ও জর্ডানে একটি বিমান ঘাঁটি রয়েছে।
আল জাজিরার প্রতিবেদক দোরসা জাব্বারি বলেন, ‘এই অঞ্চলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯টি মার্কিন ঘাঁটিতে ৪০ হাজার সৈন্য রয়েছে, যার মধ্যে আটটি স্থায়ী। ইরান আগেই বলেছিল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ইরানে হামলা চালালে তারা বৈধ লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে।’
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ‘দ্য ইনস্টিটিউট ফর দ্য স্টাডি অফ ওয়ার’ শুক্রবার (২০ জুন) লিখেছিল, অতীতে এই অঞ্চলে ইরানের প্রক্সি (ছায়া) বাহিনী ছিল তেহরানের ‘প্রতিপক্ষের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রাথমিক ইরানি উপায়’।
হুথি মিলিশিয়ারা লোহিত সাগরে জাহাজ চলাচলের ওপর পুনরায় আক্রমণ শুরু করতে পারত, ইরান নিজেও হরমুজ প্রণালীতে জাহাজ চলাচলের ওপর আক্রমণ করতে পারত—যা বিশ্বের দুটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ চলাচলের পথকে একই সঙ্গে হুমকির মুখে ফেলত।
কিন্তু কোনো প্রক্সি আক্রমণ আসেনি, যা ইরানের তথাকথিত ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ এর সীমাবদ্ধতা ও ‘মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েলের সঙ্গে কয়েক মাস লড়াই করার পরে এটি কতটা ক্লান্ত’ তা প্রমাণ করে।
তবুও বিশ্ব যখন ইরানের মার্কিন হামলার প্রতিক্রিয়া জানানোর জন্য প্রস্তুত ছিল, তখনও যুক্তরাজ্যের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ইরান ইতিহাসবিদ সোমবার (২৩ জুন) আল জাজিরাকে বলেছিলেন, তিনি মনে করেন— ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ‘অফ র্যাম্প’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘প্রচুর জনসমক্ষে প্রতিবাদ হবে, কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি আবেগপ্রবণদের (চরমপন্থীদের) নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে’, যা সন্ধ্যার পরে ইরানের হামলার আগেই ঘটেছিল।
হামলাটি কীভাবে ঘটেছিল?
সোমবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৭টার দিকে ইরান কাতারে হামলা চালায়। কাতার এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেছে, ‘এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক উত্তেজনা বৃদ্ধি যা কাতার রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার স্পষ্ট লঙ্ঘন’। এটি দোহায় ইরানি রাষ্ট্রদূতকে একটি ডিমার্চ (কূটনৈতিক প্রতিবাদপত্র) জারি করেছে।
কিন্তু আনসারি যে ‘অনুভূতিপ্রবণদের’ কথা বলেছিলেন তাদের আগেই সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
‘আমি ইরানকে আমাদের আগে থেকে নোটিশ দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানাতে চাই’। ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, ‘যার ফলে কোনো প্রাণহানি সম্ভব হয়নি।
ট্রাম্পের মতে, এই সতর্কতা কাতারকে তার বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রস্তুত করার অনুমতি দিয়েছে, যার ফলে ১৩টি ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত হয়েছে ও একটিকে ‘অ-হুমকিপূর্ণ দিকে’ উড়তে দেওয়া হয়েছে।
স্যাটেলাইট চিত্র থেকে জানা যায়, ইরানে হামলার আগেই যুক্তরাষ্ট্র আল উদেইদ থেকে কর্মী ও বিমান সরিয়ে নিয়েছিল, তাই সেখানে হামলা চালানোর ফলে হতাহতের ঝুঁকি কম ছিল। আল উদেইদে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটি বা কাতারি বিমান বাহিনীর কোনোটিরই খুব বেশি বস্তুগত ক্ষতি হয়নি।
‘আমি আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি—কোনো আমেরিকান আহত হয়নি এবং খুব কমই কোনো ক্ষতি হয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, তারা তাদের ‘সিস্টেম’ থেকে সবকিছু বের করে এনেছে’, হামলার তিন ঘণ্টা পরে ট্রাম্প লিখেছিলেন। এর মাত্র দুই ঘণ্টা পরে তিনি যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিলেন।
ট্রাম্প তার সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘সবার প্রতি অভিনন্দন! ইসরায়েল ও ইরান সম্পূর্ণ একমত হয়েছে যে, একটি সম্পূর্ণ যুদ্ধবিরতিতে যাচ্ছে তারা (এখন থেকে প্রায় ৬ ঘণ্টার মধ্যে যখন ইসরায়েল ও ইরান তাদের চূড়ান্ত অভিযান শেষ করবে!)।’
ট্রাম্প পরে প্রকাশ করেন, ‘ইসরায়েল ও ইরান প্রায় একই সঙ্গে আমার কাছে এসে বলেছিল, তারা শান্তি চায়!’
ইরানের সরকার যুদ্ধকে পেছনে ফেলে দিতে আগ্রহী ছিল। মঙ্গলবার ভোরে একটি বিবৃতি জারি করে বলেছিল, তারা ‘শত্রুদের নিষ্ঠুরতার প্রতি অপমানজনক ও দৃষ্টান্তমূলক প্রতিক্রিয়া’ প্রদান করেছে। যুদ্ধবিরতিকে ‘ইহুদিবাদী শত্রু ও তার সমর্থকদের ওপর যুদ্ধ বন্ধ করার জাতীয় সিদ্ধান্ত’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
আমেরিকা ও ইরানের সঙ্গে কাতারের সম্পর্ক কেমন?
কাতার মধ্যপ্রাচ্যের একটি ছোট দেশ হলেও আমেরিকা ও ইরান—এই দুই বিপরীতমুখী শক্তির সঙ্গেই তাদের বেশ ভারসাম্যপূর্ণ এবং গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে।
কাতার আমেরিকার ঘনিষ্ঠ কূটনৈতিক অংশীদার। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকার সবচেয়ে বড় বিমানঘাঁটি কাতারে অবস্থিত। এর পাশাপাশি কাতার আফগানিস্তানের তালেবান ও গাজার হামাসসহ বিভিন্ন জটিল কূটনৈতিক আলোচনায় আমেরিকার সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করে। এর মাধ্যমে বোঝা যায়, কাতার আমেরিকার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য সহযোগী হিসেবে কাজ করে, বিশেষ করে আঞ্চলিক শান্তি আলোচনা ও নিরাপত্তা ইস্যুতে।
অন্যদিকে, ইরানের সঙ্গে কাতারের সম্পর্ক খুবই উষ্ণ ও মূলত অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। দোহা-ভিত্তিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ রৌদি বারুদি আল জাজিরাকে জানান, কাতার ও ইরান একটি বিশাল গ্যাসক্ষেত্র ভাগ করে নেয়, যার নাম ‘দক্ষিণ পার্স ও উত্তর পার্স এবং উত্তর ফিল্ড’। এটি ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে তাদের একটি যৌথ উদ্যোগ।
বারুদি আরও বলেন, এই দক্ষিণ পার্স গ্যাসক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য পরিচিত গ্যাসক্ষেত্রের প্রায় সমান গ্যাস মজুদ রয়েছে। এই বিশাল প্রাকৃতিক গ্যাস সম্পদই দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তুলেছে।
সংক্ষেপে কাতার একদিকে আমেরিকার সামরিক ও কূটনৈতিক মিত্র, অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে তাদের শক্তিশালী অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। এই দ্বৈত সম্পর্ক বজায় রেখে কাতার মধ্যপ্রাচ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরপরই ট্রাম্প কাতারের আমিরকে ধন্যবাদ জানান।
ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, ‘আমি কাতারের আমিরকে ধন্যবাদ জানাতে চাই, এই অঞ্চলের শান্তি প্রতিষ্ঠায় তিনি যা করেছেন তার জন্য।’
এদিকে, ইরানের রাষ্ট্রপতি মাসুদ পেজেশকিয়ান মঙ্গলবার কাতারি আমিরকে টেলিফোন করে আগের দিনের হামলার জন্য ‘দুঃখ’ প্রকাশ করেছেন।
পেজেশকিয়ান স্পষ্ট করে বলেছেন, কাতার ও এর জনগণ ইরানের হামলার লক্ষ্যবস্তু ছিল না। আমিরের কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ‘পেজেশকিয়ান জোর দিয়ে বলেছেন, কাতার রাষ্ট্র একটি প্রতিবেশী, মুসলিম ও ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্র হিসেবেই থাকবে। তারা আশা প্রকাশ করেছেন, দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক সর্বদা রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধা ও সুপ্রতিবেশীসুলভ আচরণের নীতির ওপর ভিত্তি করে থাকবে।’
কাতারের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ বিন আব্দুল রহমান বিন জসিম আল-থানি বুধবার (২৫ জুন) বলেছেন, ‘উত্তেজনা প্রশমনের জন্য কাতার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সঙ্গে উল্লেখযোগ্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়েছে।’

এই প্রচেষ্টার প্রভাব কেবল ইসরায়েল ও ইরানের বাইরেও অনুভূত হবে, বারুদি পরামর্শ দিয়েছেন।
দোহা-ভিত্তিক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ রৌদি বারুদি মন্তব্য করেছেন, ‘ওয়াশিংটন ও দোহা একটি অদৃশ্য অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত বোমা নিষ্ক্রিয় করেছে।’ তিনি এর কারণ ব্যাখ্যা করে বলেন, উপসাগরীয় অঞ্চলটি আসলে অত্যন্ত বিপজ্জনক তেল ও গ্যাসের খনি, টার্মিনাল ও তেলবাহী ট্যাঙ্কার খালাসের একটি কেন্দ্র। এটি একটি বিশাল বারুদের স্তূপের মতো, যেখানে যেকোনো মুহূর্তে বড় ধরনের বিপর্যয় ঘটতে পারত।
বারুদি আরও উল্লেখ করেন, ‘পুরো অঞ্চলে উপকূল বরাবর ৩৪টিরও বেশি তেল শোধনাগার রয়েছে। আমাদের ১০৫টিরও বেশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং লবণাক্তকরণ কেন্দ্র রয়েছে।’ তাই, ইসরায়েল-ইরান সংঘাতের পর যে যুদ্ধবিরতি হয়েছে, তা এই পুরো অঞ্চলের পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের ওপর থেকে যেকোনো সম্ভাব্য বিপদ দূর করেছে। এই কারণে তিনি কাতারকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত করারও পরামর্শ দিয়েছেন।