যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তান সম্পর্কের বরফ গলাতে সামনে দুই চ্যালেঞ্জ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে এক ঘণ্টার নির্ধারিত বৈঠক গড়িয়ে প্রায় দুই ঘণ্টার দীর্ঘ আলোচনা করেছেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনির। ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউসে এই ব্যতিক্রমধর্মী একান্ত সাক্ষাতে কূটনৈতিক স্তরে এক নতুন মোড় নেওয়ার আভাস মিলেছে।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর গণমাধ্যম শাখা আইএসপিআরের বিবৃতিতে বলা হয়, বৈঠকটি প্রথমে মধ্যাহ্নভোজে শুরু হয়ে ওভাল অফিসে দীর্ঘ সময় ধরে চলে। বৈঠকে ট্রাম্প কাশ্মীর সীমান্তে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চার দিনের সাম্প্রতিক সংঘাতের পর অস্ত্রবিরতিতে পাকিস্তানের ভূমিকার প্রশংসা করেন।
বৈঠকটি গণমাধ্যম থেকে আড়ালে হলেও ট্রাম্প পরে সাংবাদিকদের বলেন, তিনি “সেনাপ্রধান মুনিরের সঙ্গে সাক্ষাতে সম্মানিত” বোধ করছেন।
তবে বিশ্লেষকরা বলছেন, এই ঘনিষ্ঠতা ও সম্পর্ক পুনর্গঠনের আড়ালে দুটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে—ইরান সংকট এবং চীনের সঙ্গে পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
বৈঠকে কী নিয়ে আলোচনা হলো?
আইএসপিআর জানায়, আলোচনায় দুই পক্ষ অর্থনীতি, খনিজসম্পদ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, জ্বালানি, ক্রিপ্টোকারেন্সি ও উদীয়মান প্রযুক্তিসহ একাধিক খাতে সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা করেন। পাশাপাশি ইরান-ইসরায়েল সংঘাত নিয়েও বিশদ আলোচনা হয়।
মুনিরের সঙ্গে ছিলেন পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা লে. জেনারেল আসিম মালিক এবং যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও ও মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক প্রধান আলোচক স্টিভ উইটকফ।
বিশ্লেষকদের দৃষ্টিতে: গোপনীয়তা এবং ভবিষ্যতের ইঙ্গিত
মধ্যপ্রাচ্য ইনস্টিটিউটের সিনিয়র ফেলো মারভিন ওয়েইনবাম বলেন, বৈঠকে সংবাদমাধ্যম না রাখা এবং কোনও ছবি প্রকাশ না করা থেকেই বোঝা যায়, আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল অত্যন্ত সংবেদনশীল।
বৈঠকের পর রাতে পাকিস্তান দূতাবাস আয়োজিত নৈশভোজেও মুনিরের বক্তব্যে তিনি এই আলোচনাকে ‘দারুণ’ ও ‘সাফল্যমণ্ডিত’ বলে অভিহিত করেন। একাধিক অংশগ্রহণকারী জানিয়েছেন, মুনির বলেন, বাইডেন প্রশাসনের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক ছিল ‘ঐতিহাসিকভাবে সবচেয়ে খারাপ’।
ইরান ইস্যু: উত্তপ্ত সীমান্তের দ্বৈত দায়িত্ব
ইসরায়েলি হামলায় ইরানি সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেই পাকিস্তান স্পষ্টভাবে ইরানের পক্ষ নিয়েছে। দেশটি ইরানের আত্মরক্ষার অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং ইসরায়েলি হামলাকে “সার্বভৌমত্বের লঙ্ঘন ও উসকানি” হিসেবে আখ্যায়িত করেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরানের পাশ্ববর্তী দেশ হিসেবে পাকিস্তানের কূটনৈতিক ভারসাম্য বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিয়া-সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর কারণে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাও একটি বড় বিষয়।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিভিত্তিক গবেষক মোহাম্মদ ফয়সাল বলেন, “পাকিস্তান ইরানে অস্থিতিশীলতা চায় না। একদিকে যুদ্ধবিরতি ও কূটনীতির আহ্বান থাকবে, অন্যদিকে প্রকাশ্যে যুক্তরাষ্ট্রপন্থী অবস্থান নেওয়াও রাজনৈতিকভাবে বিপজ্জনক।”
চীন ইস্যু: কৌশলগত টানাপড়েন
চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর (সিপিইসি) প্রকল্পে চীন ইতোমধ্যে ৬২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। সামরিকভাবে পাকিস্তানের অস্ত্রের ৮০ শতাংশই আসে চীন থেকে। এই সম্পর্ক পাকিস্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও, চীন এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হওয়ায় পাকিস্তানকে পড়তে হচ্ছে কৌশলগত চাপে।
ফয়সাল বলেন, “পাকিস্তান উভয় পক্ষের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাইলেও, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ই ইসলামাবাদকে নিজেদের দলে চাইছে। এই চাহিদাই পাকিস্তানের জন্য কূটনৈতিক সুবিধা সৃষ্টি করতে পারে।”
সম্পর্কে উষ্ণতা, কিন্তু বন্ধুতা নয়
বিশ্লেষক সাহার খান বলেন, “এই বৈঠক সম্পর্কের বরফ গলানোর ইঙ্গিত হলেও, এর মানে এই নয় যে দুই দেশ এখন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।” ট্রাম্পের অনিশ্চিত নীতির কথা মাথায় রেখে পাকিস্তানকে এখন বাস্তবতাভিত্তিক চুক্তির দিকে যেতে হবে।

তিনি বলেন, “মুনিরের বার্তা পরিষ্কার—পাকিস্তানকে ভারত, চীন বা আফগানিস্তানের প্রিজম দিয়ে নয়, আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করতে হবে।”