সিরিয়ায় ‘ভুল রাজনীতি’, বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দেবে না যুক্তরাষ্ট্র

সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেটের (আইএস) বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিতে থাকা কর্মসূচি থেকে সরে এলো যুক্তরাষ্ট্র। বেশ কয়েক বছর ধরেই সিরিয়ায় যথার্থ কোনো পক্ষকে সমর্থন দেওয়ার চেষ্টা করে আসছিল ওবামা প্রশাসন। শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র স্বীকার করল তাদের ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের উদ্যোগ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এ অর্থ দিয়ে হাজার হাজার বিদ্রোহীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া কথা ছিল। তবে যে অর্থ অবশিষ্ট থাকল তা লড়াইরত বাহিনীকে সমরাস্ত্র দিয়ে সহায়তা করা হবে।
হোয়াইট হাউস ও পেন্টাগনের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের বরাত দিয়ে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা জানিয়েছে, সিরিয়া থেকে যোদ্ধাদের বাইরে আনার কৌশল, তাদের অগ্রসর দক্ষ হিসেবে গড়ে তোলা এবং আইএস মোকাবিলায় ফিরিয়ে আনার যে নীতি ছিল তা ব্যর্থ হয়েছে। এর আংশিক কারণ হলো, বিদ্রোহীদের অনেকে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়েই বেশি মনোযোগী।
তবে মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, সিরিয়ায় তাঁরা এমন কৌশল অবলম্বন করার চেষ্টা করছেন যার মধ্য দিয়ে দক্ষ, স্থানীয় বাহিনীগুলোকে শনাক্ত করা যায়। এটা একটা বলিষ্ঠ প্রক্রিয়া বলে তাঁরা উল্লেখ করেছেন। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি—যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা বাহিনী) কিছু সময় গোপনে আসাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য বিদ্রোহীদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
ওবামার শীর্ষ উপদেষ্টা ব্রেট ম্যাকগার্ক বলেন, ‘আমাদের নমনীয় হতে হবে। আমাদের নতুন বিষয় গ্রহণে সক্ষম হতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘ওই ছেলেদের (বিদ্রোহী) বাইরে এনে প্রশিক্ষণ দেওয়া ভালো হবে নাকি যুদ্ধের ময়দানে রেখেই তাদের অস্ত্র সহায়তা দেওয়া ভালো হবে?’
সিরিয়ায় বাশার আল-আসাদের সমর্থনে রাশিয়ার সামরিক বাহিনী মোতায়েনের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের এই কৌশল পরিবর্তনের খবর এলো। গত কয়েকদিনে কাস্পিয়ান সাগর থেকে রাশিয়ার যুদ্ধবিমান সিরিয়ার বিভিন্ন লক্ষ্যবস্তুতে ওপর ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়।
আসাদের মিত্র রাশিয়া ও ইরান বলছে, আইএসসহ সব ধরনের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট। দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্র বলে আসছে আসাদই সমস্যা এবং তাঁকে ক্ষমতা ছাড়তে হবে।
গতকাল শুক্রবার পেন্টাগনের কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ‘অভিযান স্থগিতে’র ঘোষণা দেন। প্রায় একই সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশটন কার্টার ইংল্যান্ডের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মাইকেল ফ্যালনের সঙ্গে বৈঠক করেন। তাঁদের আলোচনার বিষয় ছিল সিরিয়া ও ইরাকে তাঁদের যুদ্ধ পরিচালনা।
ওয়াশিংটনে হোয়াইট হাউস ও প্রতিরক্ষা দপ্তরে কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্রোহীদের একেবারেই সাধারণ অস্ত্র সরবরাহ করা হবে। ট্যাংক বিধ্বংসী রকেট ও অন্যান্য শক্তিশালী অস্ত্র দেওয়া হবে না। কারণ শক্তিশালী অস্ত্র দিলে সেগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্রদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কাজে ব্যবহারের আশঙ্কা থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের উপজাতীয় প্রতিরক্ষা উপদেষ্টা বেনজামিন জে রোডস বলেন, ‘যেসব পক্ষ এসব কর্মকাণ্ডে (সন্ত্রাস) সম্পৃক্ত নয়, তাদের আমরা অস্ত্র দেব। এ ব্যাপারে আমরা খুব সচেতন।’
তবে কর্মকর্তারা বলছেন, আমেরিকান সেনা কমান্ডারদের কাছে পরিচিত পক্ষগুলোই কেবল এসব অস্ত্র পাবে।’ প্রতিরক্ষা বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি ক্রিস্টিন ই ওরমাথ বলেন, ‘এসব পক্ষের সঙ্গে আমরা কয়েক মাস ধরে কাজ করছি। তাদের ব্যাপারে এরই মধ্যে আমাদের দৃঢ় আস্থা তৈরি হয়েছে।’
মার্কিন প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আওতায় চলতি বছর পাঁচ হাজার ৪০০ এবং ২০১৬ সালে আরো ১৫ হাজার বিদ্রোহীকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার লক্ষ্য ছিল।
আসাদবিরোধী বিদ্রোহী সুন্নিগোষ্ঠী থুওয়ার আল-রাক্কার একজন মুখপাত্র বলেন, ‘ভবিষ্যতে সামরিক সহায়তা পাওয়ার ব্যাপারে বিপুল আশ্বাস পেয়েছি। এরই মধ্যে আমরা কিছু অস্ত্র পেয়েছি।’
এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পেন্টাগন ও সিআইএর কাছে পাঠানো এক চিঠিতে দেশটির চারজন সিনেটর বলেছেন, ‘সিরিয়ায় প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র সরবরাহের কর্মসূচি করদাতাদের ডলারের স্রেফ অপচয়। আমরা অনেকে আগেই সতর্ক করেছিলাম, যে বাহিনীকে আমরা পরাজিত করতে যাচ্ছি তাদের এখন অস্ত্র দিচ্ছি।’ এই চার সিনেটর হলেন ডেমোক্র্যাট দলের ক্রিস্টোফার এস মার্ফি, জো মানচিন, টম উডাল ও রিপাবলিকান দলের মাইক লি।
গত সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কমান্ড স্বীকার করে, সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের সরবরাহ করা অস্ত্রগুলোর এক-চতুর্থাংশই আল-কায়েদার অনুসারী নুসরা ফ্রন্টের কাছে চলে গেছে। কেন্দ্রীয় কমান্ড আরো জানায়, ছয়টি ট্রাক ও গোলাবারুদসহ সিরিয়ার বিদ্রোহীরা নুসরা ফ্রন্টের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে বলে তারা পরে জানতে পারে। এই বিদ্রোহীদের সিরিয়ার বাইরে নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল।
আরো বিস্তৃত করে বললে আসাদের সেনাবাহিনী ছাড়া আইএসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র লোকবল পাচ্ছে না। সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বারাক ওবামাও বিষয়টি উল্লেখ করেছেন।
ওয়াশিংটনভিত্তিক সিরিয়া বিশেষজ্ঞ অ্যান্ড্রু জে. ট্যাবলার বলেন, ‘বিরোধী ও আঞ্চলিক সমর্থকরা কর্মসূচিটি চায়, তবে তারা লড়াইয়ে আইএসকে প্রাধান্য দিতে চায় না। এ ছাড়া আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও অস্পষ্ট। ইরাক যুদ্ধের মতোই, লোকজন যা চায় তা না দিলে তারা আপনার পক্ষে লড়াই করবে, সেটা আপনি আশা করতে পারেন না। আমরা আবারও ভুল রাজনীতি করলাম।’