বাড়ছে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর মিছিল, বাড়ছে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব

নতুন এক মারণ ভাইরাস। তাতে আক্রান্ত হয়েছে হাজারো মানুষ। কোন ওষুধে মিলবে, প্রতিকার জানা নেই। নেই কোনো প্রতিরোধক।
আগেও এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে মানব সম্প্রদায়।
কেবল গত পাঁচ বছরে বিশ্ব মোকাবিলা করেছে ইবোলা, জিকা ও মার্স ভাইরাসের মহাসংক্রমণ। আর এখন বিশ্বজুড়ে আতঙ্কের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে আরেক ভাইরাস, যার ডাক্তারি নাম ‘২০১৯-এনসিওভি’। আর প্রচলিত নাম ‘করোনাভাইরাস’। চীনের উহান শহরে সর্বপ্রথম এই ভাইরাসের সংক্রমণের খবর পাওয়া যায়।

চীনের স্বাস্থ্য কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, দেশটিতে গতকাল বুধবার (২৯ জানুয়ারি) পর্যন্ত প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসে নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে সাত হাজার ৭১১ জনে। আর ভাইরাসের সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭০ জনে। আর তিব্বতে এই ভাইরাস আক্রান্ত একজন শনাক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে চীনের মূল ভূখণ্ডের প্রতিটি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস। চীনের বাইরে করোনাভাইরাসে কারো মৃত্যু না ঘটলেও করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছে অন্তত ১৬টি দেশে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি এ খবর জানিয়েছে।

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এরই মধ্যে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে স্বচ্ছ ধারণা রাখার বিষয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে চলছে নানা গুজব। অনেক ষড়যন্ত্রতত্ত্ব মিলছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক, টুইটার বা হোয়াটসঅ্যাপে। সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়া টুডে এ খবর জানিয়েছে।
বিজ্ঞানবিষয়ক ম্যাগাজিন ‘নেচার’ আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্যকর্মীদের উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, চীন সরকার করোনাভাইরাস বিষয়ে যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, তা অসম্পূর্ণ। বিশ্বের একাধিক দেশের গবেষকরা চেষ্টা করছেন ভাইরাসটির সঠিক মডেল সম্পর্কে জানতে। পাশাপাশি ভাইরাসটি সৃষ্টি ও ছড়িয়ে পড়ারর কারণ সম্পর্কে জানার চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কিন্তু গ্রহণযোগ্য ও নির্ভরযোগ্য তথ্যের অপ্রতুলতায় এ সম্পর্কে অনেক ভুল তথ্য ঘুরপাক খাচ্ছে অন্তর্জালসহ বিভিন্ন মহলে। এমন অবস্থায় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের পাশাপাশি উঠে আসছে জৈবিক অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ার তত্ত্বও। অনেকে এমন তত্ত্ব বিশ্বাসও করতে শুরু করেছেন অনেকে।

জৈব অস্ত্রের পরীক্ষাগার থেকে ভাইরাস ছড়ানোর তত্ত্ব
জৈব অস্ত্র হচ্ছে জৈব উপাদান থেকে তৈরি জীবাণু। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর যখন কার্যত নিষিদ্ধ নগরী। এমন পরিস্থিতিতে অন্তর্জালে ঘুরপাক খাচ্ছে পরীক্ষাগার থেকে জৈব অস্ত্র ছড়িয়ে পড়ার তত্ত্ব। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
ইসরায়েলের এক সামরিক গবেষক দাবি করেছেন, চীনের একটি গবেষণাগার থেকে বিশ্বজুড়ে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। ইসরায়েলি গবেষকের দাবি, উহানের ওই গবেষণাগারে গোপনে জৈব রাসায়নিক অস্ত্র বানায় বেইজিং।
ওই পরীক্ষাগার থেকেই সন্দেহজনকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে জৈব অস্ত্র, যার জেরেই এই করোনাভাইরাস সংক্রমণ। উহানের পরীক্ষাগার বলতে উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির কথা বলা হয়েছে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ওয়াশিংটন টাইমসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে ড্যানি শোহাম নামের ইসরায়েলের ওই সাবেক সামরিক গবেষককে ভাইরোলজি বিশেষজ্ঞ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, চীনের সামরিক বাহিনীর জন্য উহান ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজিকে ব্যবহার করা হয়। যদিও এ বিষয়ে কোনো স্বাস্থ্য সংস্থার বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
করোনাভাইরাসের সঙ্গে কানাডার যোগসূত্র
করোনাভাইরাসের ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে উঠে এসেছে কানাডার উইনিপেগে ন্যাশনাল মাইক্রোবায়োলজি ল্যাব থেকে বহিষ্কৃত বিজ্ঞানী দম্পতির কথাও। গত বছর ওই বিজ্ঞানী দম্পতি এবং তাঁদের বেশ কয়েকজন ছাত্রকে ওই ল্যাব থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে জোর আলোচনা, ওই চীনা দম্পতি করোনাভাইরাস উহান ল্যাবে পাঠিয়েছিলেন।
ষড়যন্ত্র তত্ত্ব বিশ্বজুড়ে
করোনাভাইরাসের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ার পর জানা যায়, দাবি করা হচ্ছে এ সম্পর্কিত পেটেন্ট রয়েছে ইংল্যান্ডের পিরব্রাইট ইনস্টিটিউটের কাছে। ২০১৫ সালে করোনাভাইরাসের চিকিৎসার জন্য পেটেন্টের আবেদন করা হয়েছিল বলে জানা যাচ্ছে। ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাসীরা বলছেন, ওষুধ কোম্পানির লাভের জন্যই ভাইরাসের পরিকল্পিত প্রাদুর্ভাব সৃষ্টি করা হয়েছে। এই তত্ত্বের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিল ও মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের নামও। বলা হচ্ছে, এই ফাউন্ডেশনই নাকি পিলব্রাইট ইনস্টিটিউট ও ভ্যাকসিন তৈরির জন্য অর্থ ঢেলেছিল।
বাদুড়ের স্যুপ
এরই মধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যাচ্ছে এক চীনা নারী ‘ব্যাট স্যুপ’ খাচ্ছেন। অনেক নেটিজেন বলছেন, সেখান থেকেই চীনের মানুষের খাদ্যাভ্যাসের জন্যই করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে।
এদিকে করোনাভাইরাস বৈশ্বিক জরুরি স্বাস্থ্য অবস্থা ঘোষণার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে কিনা, তা যাচাই করতে আজ বৃহস্পতিবার এক জরুরি বৈঠকে বসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।
জার্মানি, ভিয়েতনাম ও জাপানের দিকে ইঙ্গিত করে ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম জেব্রেয়াসুস বলেন, ‘গত কয়েক দিনে ভাইরাসটি যেভাবে কিছু দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, বিশেষ করে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমিত হচ্ছে, তা আমাদের চিন্তায় ফেলেছে।’
ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক আরো বলেন, ‘যদিও এখনো চীনের বাইরে (করোনাভাইরাসে) সংক্রমণের হার তুলনামূলক কম, তবুও আরো বড় পরিসরে এটা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়ে যাচ্ছে।’
এরই মধ্যে করোনাভাইরাস ঠেকাতে পুরো বিশ্বকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছে ডব্লিউএইচও। এ ভাইরাস মোকাবিলায় চীনের প্রশংসা করে ডব্লিউএইচওর জরুরি স্বাস্থ্য কর্মসূচির প্রধান মাইক রায়ান বলেন, ‘এটা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ; কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া চরম।’
এদিকে, এ ভাইরাস সম্পর্কে আরো জানতে এবং এ ভাইরাস কীভাবে সংক্রমণ হয়, সে বিষয়ে আরো ধারণা নিতে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ দল চীন যাবে বলে জানান মাইক রায়ান।
সম্প্রতি চীন সফর করা ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম জানান, এ ভাইরাস সংক্রমণের পর বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রে ‘সামান্য লক্ষণ’ দেখা গেছে। তবে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ নিউমোনিয়া ও শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যায় ভুগছেন।
ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক আরো জানান, চীনের জন্য ‘বিশ্বের সংহতি ও সমর্থন প্রয়োজন’ এবং এ পরিস্থিতিতে ‘পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানে একত্র হতে হবে’।