ভূমিকম্পের সময় ইসলামের আলোকে করণীয়

বিভিন্ন সময় পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ভূমিকম্প হয়। বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে ভূপৃষ্ঠের অভ্যন্তরে কঠিন শিলাত্বকে চ্যুতি বা স্থানান্তরের কারণে ভূমিকম্পের উৎপত্তি। পবিত্র কুরআনে ভূত্বকের খণ্ডগুলোতে পারস্পরিক আঘাতের কারণে সৃষ্ট ঝাঁকুনি ‘ধাক্কা’ [সুরা আল-ফাজর: ২১] ধারণাটি তার সমার্থক। পবিত্র কুরআনে ভূমিকম্পকে ‘রাজফাহ’ বলা হয়েছে [সুরা আরাফ:৭৮]। ভূমিকম্পের আরেকটি পরিভাষা ‘যিলযাল’, যার তীব্র প্রতিক্রিয়ায় কোনো অঞ্চল ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে পারে [সুরা যিলযাল : আয়াত ১-২]।
ভূমিকম্পের তীব্রতা কোথাও বেশি, কোথাও কম। পবিত্র কুরআন অনুযায়ী এগুলো মানুষের জন্য সতর্কবার্তা। আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি ভীতি প্রদর্শনের জন্যই নিদর্শন প্রেরণ করি [সুরা ইসরা: ৫৯]। ভূমিকম্পের সময় উচ্চ ইমারতে বসবাসকারীরা বাইরে বেরিয়ে আসার জন্য তাড়াহুড়া করে এবং প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে। কেউ কেউ ভয়ে ভূমিকম্প ভূমিকম্প বলে চিৎকার করে এবং কেউ কেউ উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে ইসলামের আলোকে আমাদের করণীয় সম্পর্কে তুলে ধরা হলো-
এক. সালাত আদায় : সাধারণ সূর্য গ্রহণ ও চদ্রগ্রহণের ক্ষেত্রে নবীজি (সা.) থেকে সালাত আদায়ের সুন্নাহ প্রমাণিত হয়েছে। ভূমিকম্পও একই প্রকৃতির বিপদ; বরং ভয়াবহ বিপদ। আবদুল্লাহ ইবন আব্বাস (রা.) ভূমিকম্পের সময় বসরায় সালাতে দাঁড়িয়ে যেতেন [বাইহাকী, আস-সুনান, ৩/৩৪৩]। ইবন কুদামা বলেন, ইসহাক ও আবু সাওরের মাযহাব অনুযায়ী সালাতুল যিলযাল আদায়ের পদ্ধতি চন্দ্র-সূর্য গ্রহণের মতো। ইমাম শাফিঈ (র.) মনে করেন, মানুষদের জন্য তীব্র ঝড়. ঝঞ্ঝা বায়ু, ভূমিকম্প, উল্কাপাতের সময় কোনো জামাত ছাড়া একাকী সালাত পড়া আমি পছন্দ করি [ইবন কুদামা, আল-মুগনী, ৩/৩৩২-৩৩৩]।
দুই. অনুশোচনা ও তওবা করা : ভূমিকম্পের সময় পাপ এবং অবাধ্যতার জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর নিকট তওবা করা মুস্তাহাব। ভূমিকম্প আল্লাহর ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ এবং সতর্কীকরণ আয়াত বা বার্তা । এ আয়াতের পিছনে তা ইচ্ছা বান্দাগণ তার কাছে ফিরে যাবে এবং অনুতপ্ত হয়ে পাপ ত্যাগ করবে। কুফায় এক ভূমিকম্পের সময় ইবন মাসউদ (রা.) বলেন, হে জনতা! তোমাদের প্রভু তোমাদেরকে তার সন্তুষ্টির দিকে ফিরিয়ে আনতে চান, তোমরা তার সন্তুষ্টি অনুসন্ধানে আসো [ইবন কাসীর, তাফসীরুল কুরআনিল আযীম, ৩/৪৮]।
তিন. যিকর, দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনা করা : দোয়ার অর্থ আল্লাহকে ডাকা। ইমাম আল-কুস্তালানী বলেন, বজ্রপাত, প্রবল বাতাস এবং ভূমিধসের মতো ভূমিকম্পের সময় দোয়া ও ইস্তিগফার করা প্রত্যেকের জন্যই মুস্তাহাব বা বাঞ্ছনীয় [আল-কুস্তালানী, ইরসাদুস সারী, ২/২৫৭]। নবীজি (সা.) বলেন, এগুলো আল্লাহর নিদর্শন যা তিনি পাঠিয়ে থাকেন কারো মৃত্যু বা জন্মের জন্য নয়; বরং আল্লাহ তার দ্বারা তার বান্দাদের সতর্ক করেন। কাজেই যখন তোমরা এমন কিছু দেখতে পাবে, তখন ভীত বিহ্বল অবস্থায় আল্লাহর যিকর, দোয়া এবং ইসতিগফারের দিকে অগ্রসর হবে [বুখারী, আস-সহীহ, ১০০০]। ইবন হাজার (র.) উক্ত হাদীস দ্বারা সূর্যগ্রহণসহ যে কোনো বিপদে যিকর, দোয়া ও ইস্তিগফারের মুস্তাহাব হওয়ার প্রমাণ গ্রহণ করেছেন [ইবন হাজার, ফাতহুল বারী, ২/৬৩৫]।
চার. তাকবীর দেওয়া ও যিকর করা : আইশা (রা.) হতে বর্ণিত হাদীসে এসব নিদর্শন বা বিপদের সময় তাকবীর দেওয়ার কথা বলা হয়েছে [বুখারী, আস-সহীহ, ১০৪৪]। ইবন আব্বাস (রা.) হতে বর্ণিত হাদীসে যিকর করার কথা বলা হয়েছে [মুসলিম, আস-সহীহ, ৯০৭]। বিপদের সময় সংক্ষিপ্ত দোয়া বারবার পড়া মুস্তাহাব। যেমন, ”ইয়া হাইয়্যু, ইয়া কাইয়্যুম, বি-রাহমাতিকা আস্তাগিস” [তিরমিযী, আস-সুনান, ৩৫২২] অথবা “আল্লাহ, আল্লাহ, রাব্বি, লা উসরিক বিহি শাইয়্যা” [আবূ দাউদ, আস-সুনান, ১৫২৫]। তবে ভূমিকম্পের সময় সবচেয়ে সুন্নাহ সম্মত দোয়া হচ্ছে, ‘আউযু বি-ওয়াজহিকা’ বলা [বুখারী, আস-সহীহ, ৬৮১৫]। শব্দ যৌগিকটির অর্থ, ‘হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করছি’।
পাঁচ. সাদাকাহ করা : ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রন্থদের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনা থাকা অপরিহার্য। উমর ইবন আবদুল আজিজ (র.) তার গভর্নরদের সিরিয়ার ভূমিকম্পের ক্ষতিপূরণে সদকার আদেশ দিয়ে লিখে চিঠি লিখেছিলেন। তাতে তিনি সাধারণ জনগণকেও ভূমিকম্পের সময় দান-খয়রাত করতে উৎসাহিত করেছেন [ইবন আবি শাইবা, আল-মুসান্নাফ, ৮৪১৪]। ফলে ভূমিকম্পের পর সাদাকাহ করা মুস্তাহাব।
ছয়. মানবতার মুক্তি : ভূমিকম্প মানবতার জন্য একটি ভয়াবহ বিপদ যা সূর্যগ্রহণের চেয়েও ভীতিকর। আসমা (রা.) হতে বর্ণিত, নবীজি (সা.) সূর্যগ্রহণের সময় গোলাম আযাদ করার নির্দেশ দিয়েছেন [বুখারী, আস-সহীহ, ৯৯৬]। ভূমিকম্পের সকল বিধানে আলিমগণ চন্দ্র-সূর্যগ্রহণের পরিস্থিতির সাথে তুলনা করেছেন। ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া একটি জাতীয় নিষ্কৃতি। ফলে তার বিনিময় হচ্ছে জীবন রক্ষার বিনিময়। অতএব ভূমিকম্প পরবর্তী সময়ে মানবতার প্রতি আরোপিত বাধ্যবাধতার পরিস্থিতি সহজতর করা ইসলামের শিক্ষা। গোলাম আজাদের স্থলে বৈদেশিক ঋণমুক্তি, বন্দী বিনিময়, কারামুক্তি কিংবা ঋণমুক্তি ইত্যাদি মানবতার মুক্তির সমতুল্য।
সাত. সতর্কতা ও জরুরি বার্তা: খলীফা উমরের (রা.) সময় মদিনায় ভূমিকম্প হয় এবং এমনকি বিছানা-পত্র এলোমেলো হয়ে যায়। আব্দুল্লাহ ইবন উমর (রা.) সালাতরত ছিলেন, কিন্তু কিছুই টের পেলেন না! তারপর উমর (রা.) জনতার উদ্দেশে খুতবা দিয়েছেন [ইবন আবি শাইবা, আল-মুসান্নাফ, ২/৪৭৩; বাইহাকী, আস-সুনান, ৩/৩৪২]। ভূমিকম্প সম্পর্কে অবহিত করে জনগণের উদ্দেশে খুতবা দেওয়া মুস্তাহাব। নবীজি (সা.) এর সময়কালে মদিনায় কোনো ভূমিকম্পের অভিজ্ঞতা নেই। তবে তিনি চন্দ্র-সূর্যগ্রহণের সময় দ্রুত মসজিদে অগ্রসর হতে নির্দেশনা দিয়েছিলেন [বুখারী, আস-সহীহ, ১০৪৭]। ভূমিকম্পসহ যে কোনো বিপদাপদের সতর্কীকরণ আগাম বার্তা জনগণের উদ্দেশ্যে প্রচার ও জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ ইসলামে বৈধ।
ভূমিকম্প একটি ভয়াবহ আপদ যা জাতিগত কারণে আবর্তিত হয়ে জাতীয় বিপর্যয় সৃষ্টি করে। তার থেকে নিস্কৃতির জন্য জাতির সামগ্রিক নৈতিক মান উন্নয়নের পাশাপাশি জাতীয় পদক্ষেপ প্রয়োজন। আমাদের জাতীয় সংকটগুলোতে আরও মনোযোগ দেওয়া এ সময়ের গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় পদক্ষেপ হতে পারে।
লেখক : ড. মুহাম্মদ তাজাম্মুল হক, অধ্যাপক, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।