বয়সের ছাপ রোধ করার চিকিৎসা কী

বয়স বাড়তে থাকলে বয়সের চাপ চেহারায় পড়তে থাকে। এ ছাড়া পরিবেশগত কারণেও বয়সের ছাপ পড়ে। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৩৭০তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. তাওহিদা রহমান ইরিন। বর্তমানে তিনি শিওর সেল মেডিকেল বিডির পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : এইজিংটা (বয়সের ছাপ) আসলে কী? কোন লক্ষণগুলো দেখলে বোঝা যায় বয়সের ছাপ পড়তে শুরু হয়েছে?
উত্তর : আমরা তো মানুষ, আমাদের দুই ধরনের বয়স আছে। একটি হলো ক্রোনোলজিক্যাল, আরেকটি বায়োলজিক্যাল। ক্রোনোলোজিক্যাল হচ্ছে জন্ম থেকে আজ পর্যন্ত আমার বয়সটা। আর আমাদের জীবনযাপন, পরিবেশগত কারণ—সবকিছুর কারণে আমাদের ত্বকে বা চুলে যে প্রভাব পড়ে, সেটি হলো বায়োলজিক্যাল বয়স। এর সাথে মানসিক স্বাস্থ্য বলেও একটি বিষয় আছে।
প্রশ্ন : কোন কোন বিষয় দেখলে বোঝা যাবে বয়সের ছাপ পড়তে শুরু করেছে?
উত্তর : এখন আসলে বয়সের ছাপ পড়ার তেমন কোনো বয়স হয় না। আগে দেখা যেত ৪০ বছর বয়সে লক্ষণগুলো প্রকাশ পেত। কিন্তু আমি ওই যে বললাম একটি বায়োলজিক্যাল বয়স আছে, এ কারণে দেখা যায় বিশ বা ত্রিশের শুরুর দিকেই এই লক্ষণগুলো দেখা যায়। সুক্ষ্ম সুক্ষ্ম বলিরেখা পড়ছে, চোখের নিচে কালো হয়ে যাচ্ছে, মুখের বিভিন্ন জায়গায় প্যাচ হচ্ছে যাকে আমরা মেছতা বলি, ত্বকটা ঝুলে ঝুলে যাচ্ছে। আমাদের যে টান টান ভাব বা লাবণ্য—এটা থাকছে না।
এরপরে আছে চুল। চুল পাতলা হয়ে যাচ্ছে, চুল পড়ে যাচ্ছে, সবই হলো বয়সের ছাপের চিহ্ন।
প্রশ্ন : তাহলে অ্যান্টি এইজিং ( বয়সের ছাপ রোধ) বিষয়টি কী?
উত্তর : বয়সের ছাপ রোধ হলো একটি শিল্প। আর আমরা ডার্মাটোলজিস্টরা শিল্পী। ক্লায়েন্ট ও আমরা—উভয় পক্ষের ওপরই বিষয়টি নির্ভর করে। আমরা কীভাবে দিচ্ছি আর তারা কীভাবে নিচ্ছে।
বয়সের ছাপ পড়ার প্রথম যে কারণগুলো কাজ করে এর মধ্যে জেনেটিক বা হেরিডেটারি। দেখা যাচ্ছে, একই শ্রেণীতে দুজন ছেলেমেয়ে আছে, একই বয়সই। তবে একজনকে একটু বেশি বয়স্ক লাগছে। যাকে বয়স্ক লাগছে তাকে জীবনযাপনের ধরনটা একটু পরিবর্তন করতে হবে।urgentPhoto
এরপর আসছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। খুব চাপের মধ্যে থাকি, উদ্বেগে থাকি, কম ঘুম হচ্ছে, কর্মব্যস্ততা অনেক বেড়ে গেছে। নিজেকে ভালোবাসা বা যত্ন নেওয়ার যে একটি সময় সেটি কমে যাচ্ছে।
এরপর আসছে পরিবেশগত কারণ। দূষণ, যানবাহনের ধোঁয়া। আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি—যেটা একটি প্রধান কারণ; এই সবকিছুর কারণেই বার্ধক্যের লক্ষণগুলো বেশি দেখা দিচ্ছে।
প্রশ্ন : বয়সের ছাপ কমাতে আপনাদের পদ্ধতি কী থাকে?
উত্তর : আমরা প্রথমে প্রাকৃতিকভাবে শুরু করতে চাই। ক্লায়েন্ট স্বাভাবিকভাবে তার বয়সের ছাপটা রোধ করতে পারবে। প্রথমে হলো খাদ্যাভ্যাস। এখন খাদ্যাভ্যাস মানে যে দামি কিছু খেতে হবে তা কিন্তু নয়। সহজে পাওয়া যায়, গাঢ় শাকসবজি যেমন গাজর, পুইঁ শাক, পালং শাক; এগুলো খেতে বলি।
এরপর আসছে ফল। মৌসুমি ফল যেগুলো আছে—বড়ই, জাম, স্ট্রবেরি; এগুলো কিন্তু খুব বেশি দামি নয়। কার্বোহাইড্রেট কমিয়ে দিতে হবে, প্রোটিন সাথে রাখতে হবে। প্রোটিন যেমন : দুধ, ডিম, দই- এগুলো খাবে। এরপরও দেখা যায় আমরা আমাদের খাদ্যাভ্যাসে তেমন সচেতন নই। কিছুটা ঘাটতি থেকেই যায়। তখন আমরা সাপ্লিমেন্ট দিয়ে থাকি। সেটা হলো অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সুপার অক্সাইড।
প্রশ্ন : খাদ্যতালিকা কি আপনারা রোগীকে বলে দেন?
উত্তর : হ্যাঁ, আমরা খাদ্যতালিকা বলে দেই। দেখা যায়, ক্লায়েন্ট কার্ব খাচ্ছে, এটাকে কমিয়ে দিতে বলি। বলি প্রোটিন বাড়িয়ে দিতে, সেই সাথে সবজি, ফল রাখতে। এখন তো কর্মব্যস্ততা। আমরা বলি—অফিসে স্ন্যাকস নিয়ে নিন, একটু ফল নিয়ে নিন, বাদাম নিয়ে নিন। কোমল পানীয় বাদ দিয়ে ডাবের পানি, লেবুর রস খান।
এরপর বাড়তি কিছু সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়। এখন ভালো ভালো কিছু সাপ্লিমেন্ট আছে। পিমরোজ অয়েল, স্পিলুনা, সুপার অক্সাইড, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এগুলো অক্সিডেটিভ স্ট্রেস কমিয়ে ফ্রি র্যাডিকেলের সাথে যুদ্ধ করে বলিরেখাকে কমিয়ে দেয়। এতে ভালো ফলাফল পাওয়া যায়।
প্রশ্ন : এর সাথে সাথে, আর কী কী করেন? ক্লায়েন্টরা আপনাদের কাছে আর কী কী সমস্যা নিয়ে আসে?
উত্তর : দেখা যায়, ২০ বছরের একজন শিক্ষার্থী এসেছেন। কী হয়েছে? রোদে পুড়ে গেছে। রোদে পুড়ে মুখে অনেক সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে তাঁকে আমরা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে বলি। যদি ব্রণ থাকে তাকে বলি সাধারণ যে ময়েশ্চারাইজার আপনি ব্যবহার করছেন সেগুলো থামিয়ে তেল নিয়ন্ত্রক, তেল ফ্রি, ওয়াটার বেজ, স্যালিসাইলিক বা সালফারযুক্ত কোনো একটি ক্লিনজার দিয়ে মুখকে পরিষ্কার করবেন। এরপর একটি অ্যান্টিবায়োটিক বা বেনজেল পারঅক্সাইডযুক্ত লোশন ব্যবহার করবে।
এরপরও যদি কনভেনশনাল থেরাপি ফেল করে তখন আধুনিক চিকিৎসাগুলো দিয়ে থাকি। যেমন ডায়মন্ড পিল। এগুলোকে ফিজিক্যাল রিজুভিনেশন বলে।
প্রশ্ন : কী কী ধরনের পদ্ধতি রয়েছে, যেগুলো আমাদের দেশে পাওয়া যায়?
উত্তর : এক সময় ছিল এই অ্যাসথেটিক মেডিসিনের জন্য সব রোগী দেশের বাইরে চলে যেত। তবে এখন কিন্তু আমাদের দেশে সহজে পাওয়া যায়। দেখা যাচ্ছে, আপনার নিজের শরীর থেকে রক্ত নেওয়া হচ্ছে, সেই রক্ত থেকে প্লাটিলেটকে আলাদা করা হচ্ছে। এই যে প্লাটিলেটকে আলাদা করছি স্বাভাবিক রক্তের তুলনায় বৃদ্ধি থাকছে। এই বৃদ্ধির বিষয়টি আমরা যেখানে লাগাচ্ছি, মনে করেন কেউ চুল পড়ে যাওয়ার জন্য করছে, কেউ বলিরেখার জন্য করছে, কেউ চোখের কালো দাগ দূর করার জন্য করছে। এই বৃদ্ধির বিষয়টি (গ্রোথ ফ্যাক্টর) আমরা কাজে লাগাচ্ছি। তখন কোলাজেন সিনথেসিস উদ্দীপ্ত হয়। আমাদের ত্বকের তারুণ্যের একটি কারণই তো কোলাজেন। কোলাজেন বয়সের সঙ্গে সঙ্গে কমে যাচ্ছে। সেটা আবার উদ্দীপ্ত করে বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা প্রকৃতিগতভাবে আমরা নিজের রক্ত থেকে করছি। এটা অনেক কাজে দেয় এবং পদ্ধতিটি অনেক জনপ্রিয়।
প্রশ্ন : পদ্ধতিটির কি কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে? বা পুনরায় কি হওয়ার আশঙ্কা আছে?
উত্তর : এই পদ্ধতির পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। অ্যালার্জি নেই। রোগী আসবে এক ঘণ্টার মধ্যে চলে যাবে। অফিসে যেতে পারে। পার্টিতে যেতে পারে। তবে হালকা একটু লালচে ভাব দেখা যেতে পারে। তবে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এটি চলে যায়।
আর বয়সের সাথে সাথে কিন্তু কোলাজেন চলে যায়। এখন পিআরপি পদ্ধতি দিয়ে আমি কোলাজেনকে আবারও বাড়ালাম। দেখা যাবে দুই বছর পর হয়তো কোলাজেন একটু কমে যাবে। রোগী যদি চায় আবার দুই বছর পর একটি সেশন নিতে পারে।
প্রশ্ন : ফলোআপের জন্য কি তারিখ দিয়ে দেন?
উত্তর : আমরা দুই তিনটি সেশন মাসে মাসে করে তাকে ঠিক করে দেই। এর দুই বছর পর যদি রোগীর মনে হয় আমি আবার সেই রকম উজ্জ্বলতা চাই, রোগী নিজে নিজেই চলে আসে।
প্রশ্ন : রোগী নির্বাচনের ক্ষেত্রে কি কোনো বিষয় কাজ করে?
উত্তর : কোন পদ্ধতি কোন রোগীকে দেব, এই বিষয়টি দেখতে হয়। পিআরপি এমন একটি পদ্ধতি যেটা আমরা সব রোগীকে দিতে পারি। ২৫ বছরের একজন ক্লায়েন্ট যদি চোখের নিচে কালো দাগ নিয়ে আসে আমরা এটা দিতে পারি। আর ডার্মাবেশন এগুলো আমরা ২০ বছর থেকে শুরু করতে পারি। ৪০ বছরে রোগী চোখের নিচে কালো দাগ নিয়ে এলে আল্ট্রাসাউন্ড, রেডিওফ্রিকোয়েন্সি, ডায়মন্ড পিল—সবকিছু করতে পারি। মুখের ঝোলাভাব দূর করতে পারি। প্রাকৃতিকভাবে কীভাবে ঠিক করা যায় সেটি করতে হবে।
প্রশ্ন : এসব চিকিৎসার পাশাপাশি জীবনযাপনের পরিবর্তন কীভাবে ঠিক করবে- সেই বিষয়েপরামর্শ কী থাকে?
উত্তর : আমি প্রথমেই বলেছি যে ভারসাম্যপূর্ণ একটি খাবার আপনাকে খেতে হবে। ঘুমাতে হবে পর্যাপ্ত। ছয় থেকে আট ঘণ্টা ঘুম। শিথিল হতে হবে। যোগব্যায়াম, ধ্যান সবকিছু করবেন।
এখন কিন্তু ফিজিওথেরাপিও বয়সের ছাপ রোধ করার একটি অংশ। আমরা কি মনে করি একজন রোগী, আরথ্রাইটিসের রোগী সে ফিজিওথেরাপি করল। আসলে কিন্তু তা নয় আমরা যে স্বাভাবিক জীবনযাপন করছি, আমাদের যে হাঁটাচলা—আসলে এসব অঙ্গবিন্যাসের কারণে মুটিয়ে যাচ্ছে। এসবের ক্ষেত্রে আমরা যদি কোনো ফিজিওথেরাপিস্টের কাছে গিয়ে পরামর্শ নিই, দেখা যাবে আমাদের হালকা কিছু ব্যায়াম দিলেন। আমাদের সেন্টারে যেতে হচ্ছে না। আমরা নিজেরাই যোগব্যায়াম, ব্যায়ামের সাথে সেসব করছি।