সড়ক দুর্ঘটনা : তাৎক্ষণিকভাবে কী করবেন

প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১২ লাখ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন এবং আহত হন পাঁচ কোটির বেশি। ১৯৯০ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, সড়ক দুর্ঘটনাজনিত প্রাণহানি সংখ্যার দিক দিয়ে নবম স্থান অধিকার করে আছে। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে এটি তৃতীয় স্থানে পৌঁছাবে। এ ধরনের হতাহতের কারণে জাতীয় অর্থনীতি উল্লেখযোগ্য ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয়, যা বার্ষিক জিডিপির ১ থেকে ৫ শতাংশ।
বাংলাদেশে যদিও সঠিক পরিসংখ্যান নেই, তবু ২০০৩ সালের একটি খণ্ড প্রতিবেদনে দেখা গেছে, বছরে প্রায় তিন হাজার লোক মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়। যদিও এ সংখ্যা ১০-১২ হাজার পর্যন্ত বলে ধারণা করা হয়।
যতজন নিহত হয়, তার তিন গুণকে চিরস্থায়ী পঙ্গুত্ব বরণ করতে হয়। ১০ গুণকে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয় এবং ৩০ গুণকে চিকিৎসা নিতে হয়।
বেশির ভাগ দুর্ঘটনাই সড়ক ও জনপথের দূরপাল্লার যানবাহনে পল্লী এলাকায় সংগঠিত হয়, শতকরা যা প্রায় ৭০ ভাগ। দুর্ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিক প্রাথমিক কতিপয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে প্রাণহানি ও পঙ্গুত্ব কমতে পারে।
এ জন্য প্রাথমিক অবস্থায় কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি। প্রথমেই লক্ষ রাখতে হবে, আহত ব্যক্তির শ্বাস-প্রশ্বাস ঠিক আছে কি না। এ ক্ষেত্রে নাসারন্ধ্র ও নাক-মুখ পরিষ্কার করে দেওয়া জরুরি। রক্ত, মাটি, কাদা, ঘাস দিয়ে শ্বাসপথ বন্ধ থাকলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই রোগীর মৃত্যু হতে পারে। আহত ব্যক্তির শ্বাসপথ পরিষ্কার করার পরও যদি শ্বাস না নেয়, তাহলে আহত ব্যক্তির মুখের সঙ্গে মুখ লাগিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালু করতে হবে। অজ্ঞান ব্যক্তিকে পুরোপুরি চিত করে শুইয়ে দেওয়া বিপজ্জনক। এ কারণে জিহ্বা পেছনে উল্টে গিয়ে শ্বাসনালি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এ জন্য চামচজাতীয় কিছু মুখে প্রবেশ করিয়ে রাখলে এ আশঙ্কা কমে যায়। এ ছাড়া মাথা একটু কাত করে রাখতে হবে। এতে করে জমা হওয়া লালা ও শ্লেষ্মা মুখের কোনা গড়িয়ে পড়তে পারে।
শ্বাস-প্রশ্বাস শুরু হওয়ার পরই যে বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে সেটি হলো রক্তক্ষরণ। দেহের ভেতরের রক্তক্ষরণ বোঝা যায় না। এ জন্য দুর্ঘটনাস্থলে কিছু করারও থাকে না। চোখে দেখা রক্তক্ষরণের ব্যবস্থা নিতে হবে সঙ্গে সঙ্গেই। মানুষের শরীরে পাঁচ-ছয় লিটার রক্ত থাকে। এক সঙ্গে এর এক-তৃতীয়াংশ রক্তক্ষরণ হলে মৃত্যু অবধারিত। রক্তক্ষরণ স্থানে কাপড় দিয়ে চেপে বা বেঁধে তা বন্ধ করতে হবে। হাতে বা পায়ে এ ধরনের ক্ষতস্থানের উপরিভাগে গামছাজাতীয় কাপড় দিয়ে সজোরে বেঁধে সাময়িকভাবে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ রেখে দ্রুত হাসপাতালে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, হাতের ক্ষেত্রে সোয়া ঘণ্টা ও পায়ের ক্ষেত্রে দেড় ঘণ্টার বেশি বেঁধে রাখা যাবে না। এতে রোগীর হাত-পা পচে যতে পারে। হাসপাতালে আনতে বেশি দেরি হলে এক-দেড় ঘণ্টা পর দুই থেকে তিন মিনিটের জন্য বাঁধন খুলে রক্ত সঞ্চালন করে পুনরায় বেঁধে দিতে হবে। তাহলে পচে যাওয়া বা গ্যাংগ্রিন হওয়ার আশঙ্কা থাকে না।
প্রাণহানি বা পঙ্গুত্বের একটি বিশেষ কারণ হলো মাথা বা মেরুদণ্ডের আঘাত। মাথায় আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিতে হবে। মেরুদণ্ডের ক্ষেত্রে ঘাড়ে আঘাত পাওয়া ব্যক্তির মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেশি। সে ক্ষেত্রে ঘাড় যদি খানিকটা শক্ত থাকে বা আঘাতের চিহ্ণ পাওয়া যায়, তাহলে আহত ব্যক্তিকে ঘাড়ে কোনো অবস্থায় নাড়া যাবে না। এতে স্নায়ুরুজ্জু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে তাৎক্ষণিক মৃত্যু হতে পারে। মাথার নিচে বালিশ ব্যবহার করা উচিত নয়। মাথা সামনের দিকে না ঝুঁকে পেছনের দিকে ঝুঁকে থাকা নিরাপদ। সে জন্য একটা তোয়ালে বা গামছা গোল করে পেঁচিয়ে গলার নিচে দেওয়া সুবিধাজনক। মেরুদণ্ডে আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে স্থানান্তরের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ওঠানো বা নামানোর ক্ষেত্রে ছয় থেকে আটজন একসঙ্গে ধরে সমান রেখে শোয়াতে হবে। একটি গাছের গুঁড়ি যেভাবে স্থানান্তর করতে হয়, সেভাবে করতে হবে।
হাত-পায়ের হাড় ভেঙে গেলে রোগীকে স্থানান্তরে কিছু ব্যবস্থা নিতে হবে। নড়বড়ে হাড়গুলো যাতে পাশের রক্তনালি বা স্নায়ুকে ক্ষতি করতে না পারে, সে জন্য ভাঙা জায়গাটি অচল রেখে রোগীকে হাসপাতালে নিতে হবে। হাতের কাছে তক্তা বা বাঁশের ফালি পেলে এর ওপর ভাঙা অঙ্গটি রেখে গামছা বা রুমাল দিয়ে বেঁধে দিতে হবে। শিশু-কিশোরদের ক্ষেত্রে কলাগাছের বাকল তক্তার পরিবর্তে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিছু পাওয়া না গেলে ভালো পায়ের সঙ্গে বা শরীরের সঙ্গে বেঁধেও ভাঙা অংশটি স্থির রাখা যেতে পারে।
এ ধরনের প্রাথমিক ব্যবস্থা নিয়ে দ্রুত আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, আহত ব্যক্তির চিকিৎসায় প্রথম ছয় ঘন্টাকে ‘গোল্ডেন আওয়ার’ বলে। কারণ, এ সময়ের মধ্যে উপযুক্ত চিকিৎসা দিতে পারলে প্রাণহানি ও পঙ্গুত্বের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়।
এমনি সময়মতো উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আহত ব্যক্তিকে হাসপাতালে স্থানান্তরের লক্ষ্যে পর্যাপ্ত উপযুক্ত যানবাহনের ব্যবস্থার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের জন্যও সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে গণসচেতনতা বৃদ্ধিসহ পর্যাপ্ত নিয়ন্ত্রিত ও পরিমিত ট্রাফিক ব্যবস্থা, ড্রাইভারদের প্রশিক্ষণ ও উপযুক্ত যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করা জরুরি।
লেখক : মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ