হৃদরোগের সার্জিক্যাল চিকিৎসা কী?

হৃদরোগ হলে কখনো কখনো সার্জিক্যাল চিকিৎসার দিকে যেতে হয়। আজ ২৬ আগস্ট এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৩২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ল্যাবএইড কার্ডিয়াক হাসপাতালের কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগের পরামর্শক ডা. আমিরুল ইসলাম ভূঁইয়া।
প্রশ্ন : হৃদরোগ অত্যন্ত আতঙ্কের একটি নাম আমরা জানি। এই রোগে আক্রান্ত হলে কারো কারো সার্জিক্যাল চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। হৃদরোগ হলে সাধারণত কোন পর্যায়ে গেলে সার্জিক্যাল জায়গায় যাওয়ার প্রয়োজন হয়?
উত্তর : আমরা আগে বুঝব হৃদরোগটা কী? আমরা জানি হার্ট একটা পাম্পিং অরগান। শরীরের রক্তগুলোকে পাম্প করে রক্তে সঙ্গে অক্সিজেন এবং পুষ্টি সারা শরীরে ছড়িয়ে দেওয়া তার কাজ। শুধু হৃদরোগ বলতে আমরা বুঝি করনারি বা রক্তনালি যেটা হার্টকে সাপ্লাই দিচ্ছে, সে রক্তনালিতে যদি কোনো ব্লক হয়, তখনই আমাদের বড়দের যে হৃদরোগ হয় সেটা। সেটা কীভাবে হয়? আমরা তো জানি হার্ট অন্যান্য অংশে রক্ত সঞ্চালন করে অক্সিজেন এবং পুষ্টি পরিবহন করে। কিন্তু পাশাপাশি মনে রাখতে হবে হার্টেরও অক্সিজেন এবং পুষ্টির প্রয়োজন পড়ে। কারণ যে কাজ করবে তারও তো শক্তি দরকার, চাহিদা রয়েছে। তাহলে এই রক্তনালিগুলোর কাজ হচ্ছে তাকে প্রয়োজনমতো রক্ত সরবরাহ করা যতটুকু লাগে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এই রক্তনালিগুলোতে জন্মের পরপরই অথবা ভ্রূণ অবস্থায় ক্যালসিয়াম, কোলেস্টেরল জমতে থাকে আস্তে আস্তে। সেটা বিভিন্ন কারণে মানুষের যখন মধ্যবয়স শুরু হয়ে যায়, তখন গিয়ে দেখা যায় বাড়তে বাড়তে ৫০ শতাংশ বা তার ওপরে বেড়ে যায়। তখন রক্তনালি অনেক সরু হয়ে যায়। ধরেন যে ৫০ শতাংশ বা তার বেশি সরু হয়ে গেল তখন লোকটি যখন কোনো চাহিদামূলক কোনো কাজ করে তখন হার্টের নিজস্ব চাহিদা পূরণ হয় না। সে অক্সিজেন এবং পুষ্টি শূন্য হয়ে পড়ে।urgentPhoto
আপনি যখন স্বাভাবিক কাজ করছেন, তখন পুষিয়ে নিল। কিন্তু আপনি যখন বাড়তি কাজ করছেন বা আপনার কোনো দুশ্চিন্তা রয়েছে বা কোনো শীতের জায়গায় গেলেন, তাহলে দেখা গেল ভালো, ৫০ শতাংশ কাভার দিতে পারছে না।
প্রশ্ন : তখন কী সমস্যা হয়?
উত্তর : তখন তার অক্সিজেন পরিবহন কমে যায়। তখন সে একটা মৃতপ্রায় অবস্থায় পড়ে যায়। বলে আমার অক্সিজেন কমে গেছে, সেটা দাও। তার এই বলাটা বিভিন্নভাবে প্রকাশ পায়। বিশেষ করে স্নায়ুগুলো যে আছে সেগুলোর আশপাশের জায়গায় ছড়িয়ে দেয়। তখন সেগুলো বলে হার্ট সমস্যার মধ্যে রয়েছে তাকে উদ্ধার করো।
আরেক সমস্যা হয়। হঠাৎ করে কোলেস্টেরলের কারণে কিছু জায়গায় রক্ত জমাট বাঁধা অবস্থা তৈরি হয়। তখন সরু পাইপটা পুরোটাই ব্লক হয়ে যায়। তখন তো হার্টের অবস্থা আরো খারাপ হয়। সে চিৎকার করতে থাকে সেটা নার্ভের মাধ্যমে আরো ছড়িয়ে পড়ে।
এখন তার চিৎকারে কী কী সমস্যা হয়? প্রথম কথা হচ্ছে তার ৫০ শতাংশ বা তার বেশি ব্লক হলে যখন শরীরচর্চা বা কোনো ব্যায়াম করে তখন বুকে বেশ চাপা ব্যথা হয়। সেটা মধ্য অবস্থায় হতে পারে। এ ছাড়া বাম হাত, ঘাড়ে ছড়িয়ে যেতে পারে। আবার সে যখন বিশ্রাম নিল, তার হার্টের চাহিদা পূরণ হলো বিষয়টি তখন ঠিক হয়ে গেল। ব্যথা কষ্ট কমে গেল। আর আরেকটি হলো শ্বাসকষ্ট হতে পারে। যখনই রক্ত জমাটবাঁধা ১০০ শতাংশ হয়, তখন বিশ্রাম নিলেও ব্যথা ভালো হয় না। বিশ্রাম নিলেও ব্যথা থাকবে এবং ঘুমিয়ে থাকলেও ব্যথা কমবে না। ব্যথার সঙ্গে শ্বাসকষ্ট হয়। বমি হতে পারে। সেগুলো মারাত্মক লক্ষণ।
প্রশ্ন : এ রকম সমস্যা হলে আপনাদের কাছে যাওয়ার পর এনজিওগ্রাম করে রোগীর অবস্থা হয়তো বুঝলেন। এরপর কোন অবস্থায় সার্জারি করতে হবে কি হবে না এটা কীভাবে নির্ধারণ করেন?
উত্তর : কিছু অংশের জন্য লাইফস্টাইল মোডিফিকেশন বা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করলেই তার এই সমস্যার সমাধান হয়ে যেতে পারে। তখন তাকে আমরা কনজারভেটিভ চিকিৎসা দিই। কিছু অংশের জন্য ওষুধ দিতে হয়। সেই জায়গাটা সরু হয়ে গেছে সেখানে তো ১০০ ভাগ রক্ত পরিবহন করতে হবে সেখানে রক্তকে একটু তরল করে দিতে হবে। আগে ঘন রক্ত ছিল। এখন তরল রক্ত একটু বেশি পরিবহন করবে। আরেকটি হতে পারে রক্তনালিকে একটু মোটা করার জন্য ওষুধ দিতে পারি। তাতে হার্টের রক্তের পরিবহন বেড়ে গেল। আরেকটি হতে পারে হার্টের নিজের চাহিদায় আমরা কমিয়ে দিতে পারি। সে যেন বেশি না চায়, বেশি কাজ না করে।
কিন্তু যখনই রক্ত জমাটবাঁধা অবস্থায় ১০০ ভাগ ব্লক হয়ে গেল, হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল তখন রোগী আমাদের কাছে আসার পরে ইসিজি করি, ইকো করি। এরপর একটা এনজিওগ্রাম করি ওই মুহূর্তে। কারণ আমার হার্টকে উদ্ধার করতে হবে। সে কাঁদছে এবং মৃতপ্রায় হয়ে যাচ্ছে। মরে যেতে পারে। তখন আমরা একটা এনজিওগ্রাম করি। করার পর যদি দেখি ব্লক ঠিক আছে ছুটিয়ে দেওয়া যাবে, তখন আমরা জায়গামতো রিং পরিয়ে দিই। তখন হার্ট দ্রুত মরে যায় না। মৃতপ্রায় অবস্থা ছিল, অক্সিজেন পাওয়ার পর সেটা ফিরে আসল। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে রিংও পরানো যাচ্ছে না। তখন আমরা বলি এটাকে সার্জারিতে নিয়ে যেতে হবে। তখন কার্ডিওলজিস্টরা আমাদের কাছে পাঠান। তখন আমরা বাইপাস করে দিই। বাইপাস মানে বিকল্প রাস্তা। ব্লক তার জায়গাতেই থাকবে তবে আমরা একটা বিকল্প রাস্তায় আমরা ১০০ ভাগ অক্সিজেন, পুষ্টি পরিবহন করে দিই। কিছু কিছু রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে বাইপাস করলেও হচ্ছে না তার সম্পূর্ণ আর্টারিতেই মারাত্মক রোগ। তখন আমরা আর্টারি কেটে আবার পুনরায় মেরামত করে দিই। এটা একটা হতে পারে। আরেকটি হতে পারে, দেখা যায় কিছু কিছু ক্ষেত্রে এত ক্যালসিয়াম জমছে, কোলেস্টেরল জমছে যে হার্ট পাথরের মতো শক্ত। সেটা আমরা টান দিয়ে তুলে তারপর একটা ভেন অথবা আর্টারির একটা প্যাঁচ লাগিয়ে সেই জায়গাটা পুনরায় ঠিক করে দিই।
আবার কিছু কিছু হার্ট অ্যাটাকের রোগী দেখা যায়, একিউট ইমার্জেন্সি। এখন দেখা যায়, হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেছে। পেশিগুলো মরে যাচ্ছে। হার্ট ফুটো হয়ে গেছে। অথবা তাঁর রক্তচাপ উঠছে না, তখন আমরা দ্রুতগতিতে রোগীকে ওটিতে নিয়ে আসি। তখন সার্জনরা রোগীকে লাইফ সাপোর্টে নিয়ে নিই। বাড়তি সাহায্যের জন্য আইএবিপি মেশিন বলে সেটা দিয়ে অক্সিজেন এবং পুষ্টি চাপ দিয়ে দিয়ে হার্টে পরিবহন করি। সে অবস্থা খুলে যদি কোনো টি আর থাকে একে মেরামত করি এবং বাইপাস করে দিই।
প্রশ্ন : বাইপাস, এই বিকল্প পথ আপনারা কীভাবে করে দেন?
উত্তর : দুটো পদ্ধতির মাধ্যমে এটা করতে পারি। একটা হচ্ছে ধমনি। বুক থেকে সরাসরি ধমনি নিয়ে আমরা হার্টে বসিয়ে দিই। সেই বুকের ধমনি শুধুমাত্র ঘুরিয়ে দিই। তার রক্তের ফ্লো ঠিক থাকে রক্তের। সেটা ঘুরিয়ে দিয়ে হার্টে বসিয়ে দিই। যে জায়গায় ব্লক তার একটু নিচের দিকে। যাতে এর চাহিদা পূর্ণ হয়। আরেকটি কাজ করি, আমরা হাত থেকে আর্টারি নিয়ে, পা থেকে ভেন নিয়ে ওই জায়গায় লাগিয়ে দিই। লাগিয়ে মহাধমনিতে একটা সংযোগ করি। আরেকটা ব্লকের এদিকে দিই। এতে রক্ত চলাচল ঠিক হয়ে গেল।