কী দেখছি
সিনেমা না নাটক?

‘এখন ছবি দেখে দর্শক আর আগের মতো মজা পায় না। হল খেকে মন খারাপ করে বের হতে হয়। দিন দিন ছবির মান যে হারে নিচে নামছে তাতে এক সময় সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাবে’- এভাবেই ছবি নিয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করছিলেন রাজমনি সিনেমা হলের ম্যানেজার অহিদ।
অহিদ আরো বলেন, ‘আগের দিনের ছবি দেখে ছবি মনে হতো, কিন্তু ডিজিটাল ছবির নামে এখন যা হচ্ছে সেগুলোকে ছবি মনে হয় না। দেখলে মনে হয়, হলে গিয়ে নাটক দেখলাম। আগে কয়েকটি টিভি চ্যানেল বছরে কয়েকটি ছবি বানাত যেগুলো দেখে দর্শক বলত নাটকের মতো ছবি। আর এখন যা বানানো হচ্ছে তার বেশির ভাগই মনে হয় নাটক।’
কিছু দিন আগে নার্গিস আক্তার পরিচালিত ‘পুত্র এখন পয়সাওয়ালা’ ছবির মুক্তির দিনই জনপ্রিয় অভিনেত্রী ববিতা আর অভিনয় না করার ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, ‘এখন যা হচ্ছে এগুলোকে আমার কাছে ছবি মনে হয় না। শুটিং করার সময় মনে হয় নাটক করছি, ছবি দেখার সময় মনে হয় নাটক দেখছি। আমাদের প্রতি একটা বিশ্বাস নিয়ে দর্শক হলে আসে, আমরা এই বিশ্বাস ভাঙতে পারব না। সুতরাং ভালো গল্প, ভালো পরিচালক না পেলে আর অভিনয় করব না।’
এমনি ঘোষণা দিয়ে আমাদের দেশে কিংবদন্তি অভিনেত্রী ববিতা চলচিত্র থেকে বিদায় নিয়েছেন আপাতত। গাজীপুরের হোতাপাড়ায় একটি ছবির শুটিংয়ে খলনায়ক মিশা সওদাগর বলেন, ‘পোস্টারে আমাদের ছবি দেখে দর্শক হলে আসে, সে কারণে আমাদের নিয়ে ছবি বানানো হয়। কোনোটাকে নাটক আবার কোনোটাকে টেলিফিল্ম মনে হয়। ছবি যদি ছবির মতো না হয় তাহলে দর্শক সেই ছবি দেখবে না।’
সম্প্রতি একটি ছবির শুটিংয়ে নায়ক বাপ্পী বলেন, ‘একটা ছবি করে আমি পাই নয় লাখ টাকা । যদি ২০ দিন কাজ করে সেই টাকা পেয়ে যাই তাহলেতো আমারই লাভ। কিন্তু আমি তার ঘোরবিরোধী। গত কয়েক বছরে দর্শকদের একটা বিশ্বাস তৈরি হয়েছে আমার প্রতি। আমি চেষ্টা করি আমার অভিনীত সিনেমা যেন নাটক না হয়। কিন্তু মাঝে মাঝে কিছু সিনিয়র পরিচালকও খরচ বাঁচাতে গিয়ে সিনেমাকে নাটক বানিয়ে ফেলেন।’
পরিচালক ও অভিনেতা কাজী হায়াৎ বলেন, ‘এখনকার সময়ের ছেলেরা কোনোভাবে ছবির কাজ শেষ করতে চায়। সেটা কি সিনেমা না নাটক হলো, সেদিকে কারো খেয়াল থাকে না। এমনকি অভিনেতা-অভিনেত্রীদের দিয়ে ঠিকমতো অভিনয়টাও করিয়ে নিতে পারে না। এমনিতেই শট ওকে হয়ে যায়।’
এফডিসির সিনিয়র ক্যামেরাম্যান আজহার বলেন, ‘আগে আমরা যখন ৩৫ মিলিমিটারে শুটিং করতাম তখন অনেক হিসাব করে লাইট করতে হতো। কারণ তখন আমাদের ক্যামেরা স্থির থাকত না। সব সময় ক্যামেরা মুভ করত। আর এখন যারা ডিজিটালে কাজ করছে তারা সব কিছু ফিক্সড শটে করতে চায়। ক্যামেরা যদি এক জায়গায় স্থির থাকে তাহলে কম সময়ে বেশি কাজ করা যায়। অ্যারেঞ্জমেন্ট কম লাগে। সুতরাং কম খরচে কম সময়ে ছবির কাজ শেষ হয়ে যায়। আর অনেকে বলে যে ডিজিটালে কম লাইট লাগে। এটা আসলে ঠিক না। কারণ এখানে ফাঁকি দেওয়ার কোনো সুযোগ নাই। আপনি যা দেবেন তাই দেখাবে পর্দায়। আসলে এখন যারা কাজ করছে তাদের বেশির ভাগই নাটকের ডিরেক্টর, যে কারণে তারা ফিল্মের ভাষাটা ঠিক বোঝে না।’
নাটকের জনপ্রিয় মুখ মোমেনা চৌধুরী বলেন, ‘সারা জীবনই তো নাটকে কাজ করলাম। পুরোপুরি কমার্শিয়াল ছবিতে কাজ করতে এসে এখন তেমন কোনো পার্থক্য দেখছি না। এর আগে শুনেছি সিনেমার একটি দৃশ্য শুট করতেই সারা দিন চলে যায়। কিন্তু এখন কাজ করতে এসে দেখি তেমন কোনো পার্থক্য নেই। নাটকের ডিরেক্টররা যে সময়ে যেভাবে শুটিং করেন সিনেমাতেও একই রকম মনে হচ্ছে। তবে অভিনয়ের দিক দিয়ে কিছুটা পার্থক্য আছে। টেলিভিশনের নাটকের চেয়ে সিনেমার অভিনয়ে নাটকীয়তা একটু বেশি থাকে।’
প্রকৃতপক্ষে বর্তমানে সিনেমা ও নাটক মিলেমিশে যাচ্ছে, তাই আলাদা করে দুটো মাধ্যমের সংজ্ঞা দাঁড় করানো কষ্টকর। এটি নির্ভর করছে একটি প্রযোজনাকে দর্শক কীভাবে দেখছে তার ওপর।