ভরা বর্ষায়ও পানি নেই মানিকগঞ্জের দুই বিলে, বিপাকে কৃষক ও জেলেরা

‘বাদলা হাওয়ায় মনে পড়ে, ছেলেবেলার গান-
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর, নদেয় এল বান।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতার সঙ্গে এখন আর যেন মিল নেই প্রকৃতিরও। বাদলা হাওয়া আছে, বৃষ্টিও পড়ছে টাপুরটুপুর। কিন্তু নদীতে বান আসছে না। মানিকগঞ্জের সদর ও হরিরামপুর উপজেলার সবচেয়ে বড় ভাতছালা বিল আর দিয়ার বিলে (দিয়ার বাওর) আষাঢ়ের এই ভরা বর্ষায়ও নেই থৈ থৈ পানি। তাই জন্মেনি নতুন মাছও।
এতে দুই বিলে মাছ ধরা কয়েক শতাধিক জেলে পরিবার পড়েছেন বিপাকে। ভাতছালা আর দিয়ার বিলে পানি প্রবেশ করে ইছামতী নদী হয়ে। পদ্মা থেকে ইছামতী নদীতে পানি প্রবাহ হয়ে থাকে। ইছামতী নদীতে একাধিক জায়গায় বাঁধ দিয়ে পানি প্রবাহ বন্ধ করে দেওয়ায় ইছামতী নদীতে পানি নেই। জেলেদের কেউ কেউ পদ্মায় মাছ ধরতে গেলেও এই দুই বিলে ও ইছামতী নদীতে পানি না থাকায় আবার অনেকে পেশাও বদল করছেন।
স্থানীয় কৃষক ও জেলেরা জানান, ২০-২২ বছর আগে পদ্মা নদী থেকে ইছামতী নদী হয়ে ভাতছালা বিল ও দিয়ার বিলে পানি প্রবেশ করতো। ইছামতী নদীর দড়িকান্দি-বাহিরচর বাজার পয়েন্ট, একই নদীতে দড়িকান্দি- বাহিরচরে আরও একটি বাঁধ ও লেছড়াগঞ্জ বাজার দিয়াপাড় বাঁধের কারণে ইছামতী নদী হয়ে পদ্মা পানি এখন আর বালিরটেক হয়ে কালিগঙ্গা নদীতে প্রবেশ করে না। ফলে নদীর পার থেকে ছোট খাল হয়ে আর বিলে পানি প্রবেশ করতে পারে না। এছাড়া গোপীনাথপুর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর পদ্মাপাড় থেকে ইছামতী নদীর রামকৃষ্ণপুর মোল্লাবাড়ির খাল হয়েও ইছামতী নদীর বাহিরচরে পানি প্রবেশ করতো। সে খালেও বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ফলে বাহিরচর, পিয়াজচর ও দিয়াপাড়-পিয়াজচর দিয়ে দিয়ার বিলে পানি প্রবেশ করতে পারছে না। অন্যদিকে ইছামতী নদী পানি প্রবাহ বন্ধ থাকায় চালা ইউনিয়নের আগ্রাইল-দড়িকান্দি, খলিলপুর দিয়ে ভাতছালা বিলে পানি প্রবেশ করতে পারছে না। আগ্রাইলের উৎপল মাঝির বাড়ি সংলগ্ন ছোট সেতু বন্ধ করে পাকা সড়ক করা হয়েছে। ভাতছালা বিলে এখন কালিগঙ্গা নদীর বালিরটেক থেকে ইছামতী নদী হয়ে উল্টো দিক থেকে সরু সট্টি খাল দিয়ে পানি প্রবেশ করে। এক সময় জুন মাসের শুরু বা মাঝামাঝিতে পানি এলেও জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়েও বিলে পানি প্রবেশ করতে পারেনি।
স্থানীয় আগ্রাইল গ্রামের বাসিন্দা সজল রাজবংশী বলেন, “৩৫ বছর ধরে মাছ ধরে, সেই মাছ বিক্রি করে সংসার চালাই। একসময় ২০-৩০টি বেড় জালের নৌকা বিলে মাছ ধরতো। প্রতিটি জেলে নৌকায় ১০-১২ জন লোক মাছ ধরতো। আষাঢ় মাসে ২-৪ দিনে বিভিন্ন জায়গা দিয়ে বিলে পানি ঢুকে বিল পানিতে ভরে যেতো। ৫-৬ মাস বিলে আমরা মাছ ধরেছি। আর এখন আষাঢ় মাস শেষ। তারপরও বিলে পানিই ঢুকতে পারেনি। বিলে পানি ঢোকার জায়গা সব বাঁধ দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছে। ওইসব জায়গায় কালভার্ট দিলেও কিছু পানি ঢুকতো। ইছামতী নদীতেই তো বাঁধের কারণে পানি আসে না, বিলে ঢুকবে কেমন করে?”
মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার খাবাশপুর গ্রামের নাইম শিকদার বলেন, সদর উপজেলার কয়েকটি গ্রাম ও হরিরামপুর উপজেলার কয়েকটি গ্রামের বাসিন্দারা ভাতছালা বিলে ফসল ফলায়। ওই সকল এলাকার জেলেরা ভাতছালা বিলে মাছ ধরে।
হরিরামপুর উপজেলার রাজরা লাউতা গ্রামের পরিমল রাজবংশী বলেন, আমার বাবা-দাদারা ভাতছালা বিলে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। আমিও ভাতছালা বিলে মাছ ধরি। রাজরা, আগ্রাইল, দড়িকান্দি, লাউতা, বৈকুণ্ঠপুর, গোয়ালনগরসহ আশপাশের কয়েকটি গ্রামের জেলেরা ভাতছালা বিলে মাছ ধরে। কয়েকবছর হলো বিলে পানি হয় না। তাই দেশীয় মাছের পাশাপাশি চাষের মাছ কিনে বিক্রি করি। বিলে পানি ঢোকার ব্যবস্থার দাবি জানাচ্ছি।
আগ্রাইল গ্রামের বাসিন্দা কৃষক মোসলেম খাঁ বলেন, ৫০-৬০ বছর আগে থেইকা ভাতছালা বিলে ফসল বুনি, ধান লাগাই। এহন আমরা পানির কষ্টে আছি, পাট জাগ দেওয়ার পানিও নাই। আমন ধানও বোনা যায় না। আগ্রাইল, দড়িকান্দি, খলিলপুর, সট্টি, ইজদিয়া, লাউতা, রাজরা, গোয়ালনগর, যাত্রাপুর, উত্তর চাঁদপুর, কল্যাণপুর, সাপাইর, মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার বরুনা, কৃষ্ণপুর, খাবাশপুরসহ ২০-২২টি গ্রামের বাসিন্দারা ভাতছালা বিলে ফসল ফলায়।

ইজদিয়া গ্রামের নাসির মাস্টার বলেন, ইছামতী নদীতে পানি প্রবাহের ব্যবস্থা করা হোক। ওই পানি ভাতছালা বিল আর দিয়ার বিলে না ঢুকলে দুই বিলে ফসল কম ফলব, জেলেরা মাছ ধরবার পারবোনা।
দুলাল রাজবংশী বলেন, দিয়াবাড়ি, দিয়াপাড়, বাহিরচর, পিয়াজচর, মানিকনগর, দড়িকান্দি, আন্ধারমানিক এলাকার জেলেরা দিয়ারবিলে মাছ ধরে সংসার চালাতো। কয়েকবছর হলো বিলে সময় মতো পানি প্রবেশ করতে পারে না। পানি নেই তাই মাছও নেই।

এ বিষয়ে হরিরামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কোহিনুর আক্তার বলেন, বিলে পানি প্রবেশে কালভার্টের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে। আর রাস্তাঘাট হওয়ার কারণে পানি প্রবেশ বাধাগ্রস্ত হলেও বিষয়টা আমরা দেখবো। এ বিষয়ে পানি উন্নয়ন বিভাগকেও জানাবো।
মানিকগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ আক্তারুজ্জামান বলেন, ইছামতী নদীর পানি প্রবাহ বৃদ্ধিতে ঘিওর ও দৌলতপুর উপজেলায় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর বিলে পানি প্রবেশসহ হরিরামপুর উপজেলার ইছামতী নদীর পানি প্রবাহ স্বাভাবিক করতে প্রকল্প নেওয়া হবে।