বিশ্ববিদ্যালয় একটি, আ. লীগপন্থী শিক্ষক সমিতি দুটি

ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতি দুটি। আর দুই সমিতির রেষারেষিতে শিক্ষার পরিবেশ চরম ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এতে বিপাকে পড়েছেন সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নীল দল ও বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ নামে দুটি সংগঠন রয়েছে। দুটি সংগঠনই আওয়ামী লীগ সমর্থিত হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সিদ্ধান্ত ও প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কেন্দ্র করে দুটি দলের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বিরোধ চলে আসছে। ২০১৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে এই বিরোধ চরমে পৌঁছায়। বিরোধের জের ধরে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে পরস্পরের মধ্যে সমঝোতা না হওয়ায় দুটি দল পৃথক পৃথক শিক্ষক সমিতি ঘোষণা করেছে।
দুটি শিক্ষক সংগঠনের নেতা ও সাধারণ শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রতিবছরের ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা। নির্বাচন নিয়ে গত ৮ ডিসেম্বর শিক্ষকদের সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় আওয়ামী লীগ সমর্থক নীল দল, বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ এবং বিএনপি সমর্থিত সাদা দলের শিক্ষকরা অংশ নেন। সভায় সিদ্ধান্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর শিক্ষক সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৫ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রত্যেক দলের পক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারীরা নিজ দলের ব্যানারে মনোনয়নপত্র জমা দেবেন। সুবিধাজনক অবস্থানে না থাকায় বিএনপি সমর্থিত সাদা দল আগেই নির্বাচন না করার ঘোষণা দেয়। বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের শিক্ষকরা নির্বাচনের মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলেও তাঁরা তা জমা দেননি। ১৫ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ তাঁদের ‘প্রস্তুতি’ নেই বলে নির্বাচন পেছানোর জন্য লিখিত দাবি জানায় নির্বাচন কমিশনের কাছে। নিবার্চন কমিশনার শাহাবউদ্দিন বাদল দুই দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে তাৎক্ষণিক সভা করেন। সভা শেষে বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের নেতাদের লিখিতভাবে জানানো হয়, নির্বাচন পেছানোর সুযোগ নেই, সিদ্ধান্ত কেবল সাধারণ সভায় হতে পারে। পরবর্তী সাধারণ সভায় বিষয়টি নিয়ে সিদ্ধান্ত হবে। কিন্তু পরবর্তী সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার আগেই ২০ ডিসেম্বর অন্য কোনো দল নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত নীল দলকে বিজয়ী ঘোষণা করে কমিশন। পরে নির্বাচন কমিশন নির্বাচিত শিক্ষক সমিতিকে উপাচার্যের কাছে পরিচয় করিয়ে দিলে উপাচার্য তাঁদের বরণ করে নেন।
কিন্তু নির্বাচন ও বিজয়ী শিক্ষক সমিতিকে মেনে না নিয়ে পৃথক নির্বাচন কমিশন গঠন করে তফসিল ঘোষণা ছাড়াই গত ২৯ ডিসেম্বর একতরফা নির্বাচন দিয়ে বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ নিজেদের বিজয়ী বলে নতুন সমিতি ঘোষণা করে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের সমর্থক বিশ্ববিদ্যালয় বিবদমান শিক্ষক সমিতি, বিএনপি সমর্থিত সাদা দলের শিক্ষক নেতা, সাধারণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দুটি সমিতিই নিজেদের বৈধ শিক্ষক সমিতির দাবিদার। আওয়ামী লীগপন্থী ওই দুটি সংগঠনের শিক্ষক নেতারা এই নিয়ে অনড় অবস্থানে আছেন। যেকোনো সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে বলেও আশঙ্কা করছেন সাধারণ শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এমনকি শিক্ষার্থীরাও।
বিএনপিপন্থী শিক্ষকরা নিষ্ক্রিয় থাকায় এবং আওয়ামী লীগ-সমর্থক দুটি সংগঠন নিজেদের বৈধ শিক্ষক সমিতি দাবি করায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কাউকেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। তবে প্রশাসনিক চিঠিপত্র দেওয়া নিয়ে কিছুটা বেকায়দায় পড়েছে প্রশাসন। গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের নবীনবরণ অনুষ্ঠানকে ঘিরে মারাত্মক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিড়ম্বনা এড়াতে শিক্ষক সমিতির পরিচয়ে নেতাদের অনুষ্ঠানে অতিথি করা হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক পরিচয়ে দুটি সমিতির সভাপতিকে দাওয়াত দেওয়া হয়।
দলনিরপেক্ষ সাধারণ একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শিক্ষক সমিতি নিয়ে দুই পক্ষের আচরণ খুবই নেতিবাচক। এর প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর। সাধারণ অনেক শিক্ষক এখন দুই দলের টানাহেঁচড়ার ভয়ে অনেকটা পালিয়ে বেড়ান। গত ১০ জানুয়ারি যোগদান করা ২১ জন শিক্ষক পড়েছেন আরো বিড়ম্বনায়। বিএনপিপন্থী সাদা দল এবং আওয়ামী লীগ-সমর্থক দুটি সংগঠনের নেতারা তাঁদের নিজেদের দলে ভেড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
এ ব্যাপারে নীল দলের পক্ষের শিক্ষক সমিতির সভাপতি সহকারী অধ্যাপক সোহেল রানা বলেন, ‘আমরা নিয়মমতো বৈধ নির্বাচনে জয়ী হয়েছি। আর পরাজয়ের ভয়ে তাঁরা নির্বাচনে না এসে তফসিলবিহীন, গঠনতন্ত্রবিরোধী নিজেদের মতো নির্বাচন দিয়ে অবৈধ সমিতি গঠন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এটা সবার জন্যই লজ্জাজনক।’
বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের পক্ষের শিক্ষক সমিতির সভাপতি সহকারী অধ্যাপক রুহুল আমিন বলেন, ‘আবেদনের পর নির্বাচন কমিশন সময় বাড়াতে চাইলেও নীল দলের চাপের কারণে সময় বাড়াতে পারেনি। আমাদের অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে ইচ্ছাকৃতভাবে বঞ্চিত করায় আমরা নতুন করে নির্বাচনের মাধ্যমে সমিতি গঠন করেছি। দুটি কমিটি থাকায় আমাদের সমস্যা হচ্ছে।’ তিনি দাবি করেন, ‘আমরাই বৈধ কমিটি।’
বিএনপিপন্থী শিক্ষকদের সাদা দলের সভাপতি সহযোগী অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, কৌশলে তাঁদের নির্বাচনের বাইরে রাখতে কম সময়ে নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। নির্বাচন চলার সময় শিক্ষার্থীদের ভর্তি চলছিল। কার্যত গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো শিক্ষক সমিতি নেই। এতে প্রশাসনের সুবিধা হচ্ছে বেশি। সমস্যায় পড়েছেন শিক্ষকরা। প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীসহ গোটা ক্যাম্পাসে।
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মোহীত উল আলম বলেন, ‘তাদের (আওয়ামী লীগপন্থী) শিক্ষদের দুটি কমিটি আছে। গ্রুপিং আছে। শিক্ষকদের এ বিষয়ে উত্তরদানে আমি যথার্থ মানুষ নই।’