সরিষায় ছেয়ে গেছে ভৈরবের প্রান্তর, মৌচাষে ঝুঁকছেন খামারিরা

অল্প খরচ ও পরিশ্রমে বেশি লাভে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলায় দিন দিন বাড়ছে সরিষার আবাদ। বর্তমানে এখানকার ফসলি জমিসহ দিগন্তজোড়া মাঠ-প্রান্তর সরিষা ফুলের হলুদ রঙে ঢাকা পড়েছে। আর এই আবাদকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন এলাকায় মৌ-খামার গড়ে তুলেছেন মধুচাষিরা। সরিষা ফুলে মৌমাছির মধু আহরণ আর মধুচাষিদের মধুর বাক্স থেকে আসা মিষ্টি গন্ধে মাতোয়ারা বাতাস কৃষকের চোখে জমিয়েছে ভালো ফলনের স্বপ্ন।
উপজেলা কৃষি বিভাগ জানায়, স্বল্প খরচ ও পরিশ্রমে অধিক ফলন ও ফসল বিক্রি করে ভালো দাম পাওয়ায় সরিষা চাষে দিন দিন আগ্রহী হয়ে উঠছেন ভৈরবের কৃষকরা। ফলে এখানে প্রতিবছরই বাড়ছে সরিষার আবাদ। বীজ বোনার সর্বোচ্চ ৯০ দিনের মধ্যে সরিষার ফলন ঘরে তোলা যায় বলে পরবর্তী সময়ে বোরো আবাদের কোনো সমস্যা হয় না কৃষকদের। সামান্য পরিমাণ ইউরিয়া ছাড়া আর কোনো সারেরও প্রয়োজন পড়ে না সরিষার আবাদে। চারা গজানোর পরপর আগাছা পরিষ্কার ছাড়া তেমন কোনো শ্রমেরও দরকার হয় না। তাই প্রতি বিঘা সরিষা আবাদে সর্বোচ্চ খরচ হয় তিন থেকে চার হাজার টাকা।
সরিষাচাষি শিশু মিয়া, রহমত উল্লাহ ও আক্তার হোসেন জানান, প্রতি বিঘা জমিতে সরিষার ফলন হয় ছয় থেকে সাত মণ। আর বিক্রি করা যায় কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ হাজার টাকায়। ফলে প্রতি বিঘা সরিষা আবাদে মোট লাভ দাঁড়ায় আট থেকে নয় হাজার টাকা। তাই অল্প খরচে ভালো মুনাফা পাওয়ায় তাঁদের মতো অন্যান্য কৃষকও ধীরে ধীরে সরিষা আবাদে আগ্রহী হয়ে উঠছেন।
অন্যদিকে, এই সরিষা আবাদকে কেন্দ্র করে উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় মধুচাষিরা মৌ-খামার গড়ে তুলেছেন। খামারের প্রতিটি মৌবাক্সে সপ্তাহে তিন থেকে পাঁচ কেজি মধু আহরণ করা যায় বলে জানান খামারিরা। সেই মধু বিক্রি বেশ লাভজনক বলেও জানান তাঁরা। তবে উৎপাদিত মধু বিক্রি আর মধু চাষে বেকার যুবকদের আগ্রহী করে তুলতে ঋণের দাবি জানিয়েছেন খামারিরা।

উপজেলার আদর্শপাড়া এলাকার মৌচাষি রিমন রহমান জানান, এই মৌসুমে তিনি ২২০টি মৌমাছির বাক্স বসিয়েছেন। তিনি আশা করছেন, আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার মধু সংগ্রহ করতে পারবেন। এতে তাঁর মোট মুনাফা দাঁড়াবে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা। আর এই মুনাফা হবে এক মাস সময়ের মধ্যেই।
মৌচাষ একটি লাভজনক ব্যবসা উল্লেখ করে প্রায় একই রকম মুনাফার কথা জানালেন কালিকাপ্রসাদ এলাকার হাফিজ উদ্দিন। তিনি ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে এই মৌচাষের সঙ্গে জড়িত আছেন জানিয়ে বলেন, ‘ইচ্ছে করলে যেকোনো উদ্যোক্তা এই মৌচাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে লাভবান হতে পারেন।’
এদিকে এলাকায় মৌচাষিদের খামার থেকে সুলভমূল্যে খাঁটি মধু কিনতে পারায় বেশ খুশি স্থানীয় লোকজন। কথা হয় মধুক্রেতা বায়েজিদ, সাগর, অর্পিতা আর নাজনীনের সঙ্গে। তাঁরা জানান, চোখের সামনে মৌমাছির বাক্স থেকে মধু নিতে পারছেন তাঁরা। এর চেয়ে আনন্দের আর কী আছে? এ ছাড়া এই মধু বাজারের যে কোনো ব্র্যান্ডের মধুর চেয়ে দামেও সাশ্রয়ী, মাত্র ৫০০ টাকা কেজি।
উপজেলা কৃষি অফিসের উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা চন্দন কুমার শাহ জানান, বোরো ফসলের আগে অল্প সময়ে ও অল্প খরচে অধিক লাভবান হওয়ায় সরিষা চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন ভৈরবের কৃষক। এ ছাড়া সরিষার পাতা জমিতে পড়ার পর পচে গিয়ে জৈবসার তৈরি করে। ফলে পরবর্তী বোরো আবাদে ইউরিয়া সারের পরিমাণ কম লাগায় কৃষকরা সরিষা আবাদের দিকে ঝুঁকছেন।
অন্যদিকে সরিষা আবাদকে কেন্দ্র করে আশপাশের এলাকা থেকে মৌ-খামারিরা মৌমাছির বাক্স বসানোয় মৌমাছির মাধ্যমে পরাগায়নের ফলে জমিতে সরিষার ফলন ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি হচ্ছে বলে জানান মাঠ পর্যায়ের এই কর্মকর্তা।
চলতি বছর দুই হাজার ১০০ হেক্টর জমিতে সরিষার আবাদ হয়েছে উল্লেখ করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলম শরীফ খান জানান, এ বছর ৫০০ কৃষককে সরকারি প্রণোদনার আওতায় বিনামূল্যে বীজ ও সার দেওয়া হয়েছে। সরিষাকে তিনি আমন ও বোরো ফসলের মাঝখানে বাড়তি ফসল হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, ‘সরিষার ফলন খুব অল্প সময়ে ঘরে তোলা যায়। এতে খরচ যেমন কম হয়, তেমনি পরিশ্রমও কম হয়; অন্যদিকে মুনাফা হয় খুব বেশি। তাই এখানকার কৃষকদের এই ফসলের প্রতি আগ্রহ বেশ।’
মৌচাষকে একটি লাভজনক পেশা উল্লেখ করে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা জানান, সরিষার জমিতে মৌমাছির মধু আহরণের ফলে অতিরিক্ত পরাগায়ন ঘটে। এতে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ ফসল বেশি হয়। তিনি মধু চাষে বেকারদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আগ্রহীদের প্রয়োজনীয় সব ধরনের সহযোগিতাসহ ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।’