সামরিক শক্তিতে কে এগিয়ে, ইরান না ইসরায়েল?

ইসরায়েলি বাহিনী বৃহস্পতিবার (১২ জুন) রাতের শেষভাগে তেহরানে হামলা চালায়। এতে ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান হোসেইন সালামি ও ছয় পরমাণু বিজ্ঞানীসহ বেশ কয়েকজন নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ঘোষণা দিয়েছেন, এই হামলা অব্যাহত থাকবে। তিনি দাবি করেছেন, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর সম্ভাব্য ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার শঙ্কায় ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে আগাম প্রতিরোধমূলক হামলা চালানো হয়েছে।
হামলার ঘটনায় ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি তেহরানে হামলার জন্য ইসরায়েলকে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তিনি দেশটিকে ‘তিক্ত ও যন্ত্রণাদায়ক’ পরিণতির জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেছেন।
এই হামলার পর ইসরায়েলজুড়ে ‘বিশেষ জরুরি অবস্থা’ জারি করা হয়েছে।
অন্যদিকে, মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানিয়েছেন, এই হামলায় যুক্তরাষ্ট্র কোনোভাবেই জড়িত নয়। তিনি আরও বলেন, তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হলো মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। রুবিও ইরানকে সতর্ক করে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো স্বার্থ বা সেনাবাহিনীর ওপর হামলা চালানো হলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
ইরানে ইসরায়েলি হামলার পর জ্বালানি তেলের বাজারে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। বিশ্ববাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম ১২ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে।
এদিকে, ইরানে হামলার ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে ‘সর্বোচ্চ সংযমের’ আহ্বান জানিয়ে ইসরায়েলি হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের পক্ষ থেকে একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘তিনি (গুতেরেস) ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির অবস্থা নিয়ে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে আলোচনা চলাকালীন তেহরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে ইসরায়েলি হামলায় বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন।’ মুখপাত্র উভয় পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছেন ও যেকোনো মূল্যে গভীর সংঘাতে ডুবে যাওয়া এড়িয়ে চলতে বলেছেন।
দুই দেশের মধ্যে সরাসরি সংঘাত ঘিরে একটি আঞ্চলিক যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কাও করছেন অনেকে। কারণ সক্ষমতার দিক থেকে তুলনা করলে দেখা যায় দুটি দেশই সামরিক দিক থেকে বেশ শক্তিশালী।
এমন পরিস্থিতিতে, সামরিক শক্তিতে কে এগিয়ে—ইরান নাকি ইসরায়েল? তা নিয়ে একটি তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হলো।
সামরিক শক্তির তুলনামূলক চিত্র
‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার’-এর পরিসংখ্যান ২০২৫ অনুযায়ী, সামরিক সক্ষমতার দিক থেকে ইসরায়েলের তুলনায় ইরান এক ধাপ পিছিয়ে আছে। তবে দুটি দেশই বিশ্বের সামরিক শক্তিধর ২০ শীর্ষ দেশের মধ্যে অবস্থান করছে।
প্রতিরক্ষা বাজেট
প্রতিরক্ষা খাতে ইরান ও ইসরায়েল উভয় দেশই প্রচুর অর্থ ব্যয় করে। তবে বার্ষিক সামরিক বাজেটে ইরানের ব্যয় ৯৯৫ কোটি ডলার (১৬তম অবস্থানে), যেখানে ইসরায়েলের ব্যয় দুই হাজার ৪৪০ কোটি ডলার (১৫তম অবস্থানে)– অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি।
নিয়মিত সৈন্য সংখ্যা
সৈন্য সংখ্যার হিসেবে ইসরায়েলের চেয়ে এগিয়ে আছে ইরান।
ইরান : নিয়মিত সেনা ১১ লাখ ৮০ হাজার। রিজার্ভ সেনা তিন লাখ ৫০ হাজার।
ইসরায়েল : নিয়মিত সেনা ছয় লাখ ৭০ হাজার। রিজার্ভ সেনা চার লাখ ৬৫ হাজার।
যুদ্ধ বিমান ও হেলিকপ্টার
ইসরায়েলের সামরিক বিমানের সংখ্যা মোট ৬১২টি। অন্যদিকে ইরানের আছে ৫৫১টি। ইসরায়েলের যুদ্ধ বিমান আছে ২৪১টি, যেখানে ইরানের আছে ১৮৬টি। অ্যাটাকিং বিমান ইসরায়েলের ৩৯টি এবং ইরানের ২৩টি। পরিবহণ বিমানে ইরান এগিয়ে (৮৬টি বনাম ১২টি), তবে প্রশিক্ষণ বিমানে ইসরায়েল (১৫৫টি) এগিয়ে (ইরানের ১০২টি)।
হেলিকপ্টারের দিক থেকে ইসরায়েল (১৪৬টি) এগিয়ে, ইরানের আছে ১২৯টি। অ্যাটাক হেলিকপ্টারের সংখ্যায় ইসরায়েল (৪৮টি) বেশ শক্তিশালী, যেখানে ইরানের আছে ১৩টি।
ট্যাংক ও সাঁজোয়া যান
ট্যাংক ও সাঁজোয়া যানের দিক থেকে ইরান ইসরায়েলের চেয়ে এগিয়ে। ইরানের ট্যাংক রয়েছে এক হাজার ৯৯৬টি, যেখানে ইসরায়েলের আছে এক হাজার ৩৭০টি। সাঁজোয়া যানের সংখ্যায় ইরান (৬৫ হাজার ৭৬৫টি) ইসরায়েলের (৪৩ হাজার ৪০৩টি) চেয়ে অনেক বেশি।
আর্টিলারি সক্ষমতায়ও ইরান এগিয়ে। তাদের রকেট আর্টিলারি এমএলআরএস-এর সংখ্যা ৭৭৫টি এবং সেলফ প্রপেলড আর্টিলারির সংখ্যা ৫৮০টি। অন্যদিকে, ইসরায়েলের সেলফ প্রপেলড আর্টিলারি আছে ৬৫০টি ও এমএলআরএস বা রকেট আর্টিলারি ১৫০টি।
নৌ শক্তি
নৌবাহিনীর শক্তির দিক থেকেও ইরান এগিয়ে আছে। দেশটির ১০১টি যুদ্ধজাহাজ রয়েছে, যার মধ্যে সাতটি ফ্রিগেট এবং ২১টি টহল জাহাজ। অন্যদিকে, ইসরায়েলের যুদ্ধজাহাজ সংখ্যা ৬৭টি, যার মধ্যে ৪৫টি টহল জাহাজ ও কোনো ফ্রিগেট নেই। সাবমেরিনের দিক থেকেও ইরান (১৯টি) ইসরায়েলের (৫টি) চেয়ে শক্তিশালী।

পারমাণবিক শক্তি
স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)-এর তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের শুরুতে বিশ্বের নয়টি দেশের কাছে প্রায় ১২ হাজার ৫১২টি পারমাণবিক অস্ত্র ছিল। এই দেশগুলোর মধ্যে ইসরায়েল থাকলেও, ইরানের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে পারমাণবিক অস্ত্র কখনোই ছিল না। যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন বারবার দাবি করেছে, ইরান ইউরেনিয়ামের মজুদ দিয়ে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করছে, ইরান তাদের পরমাণু কর্মসূচিকে শান্তিপূর্ণ বলে দাবি করে।
‘গ্লোবাল ফায়ার পাওয়ার’ তাদের রিপোর্টে পারমাণবিক অস্ত্র ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়নি।