নির্ভয়ার ধর্ষককে ফেরত চায় না নিজ গ্রাম

আইন না থাকায় ভারতে দিল্লির আলোচিত নির্ভয়া ধর্ষণকাণ্ডের ‘নাবালক’ অপরাধীর মুক্তিতে স্থগিতাদেশ দিতে পারলেন না ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। আইন অনুযায়ীই মুক্তি পেয়েছে নির্ভয়া ধর্ষণে দোষী ‘নাবালক’।
এদিকে জ্যোতি সিংকে ধর্ষণের পর ‘অন্ত্র টেনে বের করে ফেলা’ ‘হিংস্র’ এই ‘নাবালকের’ মুক্তির পর ফুঁসে উঠেছে তার নিজের গ্রামও। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানিয়েছে, উত্তরপ্রদেশের বদায়ুর গ্রাম এই ধর্ষকের জন্মস্থান। সেখানে আছেন তার মা, মানসিক ভারসাম্যহীন বাবা, আর খেটে খাওয়া দুটি বোন। ২০১১ সালে বদায়ুর থেকে কাজের খোঁজে দিল্লি এসেছিল ছেলেটি।
নির্ভয়ার ধর্ষণকাণ্ডের খবর জানাজানি হতেই ২০১২ সালে উত্তরপ্রদেশের প্রত্যন্ত এই গ্রামে প্রতিবাদের রব উঠেছিল। এদিকে গতকাল ‘নাবালক’ ধর্ষকের মুক্তির পর বদায়ুরের গ্রামবাসী জানিয়ে দিয়েছে, ছেলেটি যেন গ্রামে না ফেরে। আর ফিরলে তার নিরাপত্তার দায়িত্ব নিতে হবে সরকারকেই। কারণ গ্রামবাসী চায় না এমন ‘হিংস্র ধর্ষক’ ওই গ্রামে ফিরে যাক।
এনডিটিভি জানিয়েছে, ‘নির্ভয়া’ জ্যোতি সিং-এর ‘নাবালক’ ধর্ষককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল গতকালই। তারপরেও নির্ভয়ার পরিবারসহ বিচারপ্রত্যাশী মানুষের আশা ছিল যদি ওই নাবালক দোষীর মুক্তি রদ করা যায়। সেই বিষয়ে শুনানির কথা ছিল আজ। সেই রায়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টের অবসরকালীন বেঞ্চ জানালেন, আইনে নেই, তাই দোষী নাবালককে ছেড়ে দিতে হলো!
এদিকে এই রায়ের পর ক্ষোভে ফুঁসছে দিল্লি। বিতর্কিত ‘শিশু আইন’ নিয়ে শুধু বাইরে নয়, দেশটির সংসদেও তুমুল প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিরোধীরা। নাবালকের মুক্তি রদের আর্জি হাইকোর্ট খারিজ করার পর সংসদে বিরোধীরা প্রশ্ন করেন, তাহলে কেন এই আইন পরিবর্তন করা হচ্ছে না? আর দিল্লি গেটের সামনে সোমবার বিকেলে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন হাজারো জনতা।
এদিকে নিরাপত্তার স্বার্থে গতকাল রোববার রাতেই ‘নাবালক’ ধর্ষককে কিশোর সংশোধনাগার থেকে একটি বেসরকারি হোমে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। আজ সোমবার সকালে তাকে সেখান থেকে দিল্লির একটি বেসরকারি সংশোধনালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের তরফে জানানো হয়েছে, সেখানে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার নজরদারিতে থাকবে সে। এ ছাড়া তার পুরোনো অপরাধের সব রেকর্ড মুছে ফেলা হবে।
কারাগার কর্তৃপক্ষের বরাত দিয়ে এনডিটিভি আরো জানিয়েছে, মুক্তির আগে অভিযুক্ত কিশোরের পুনর্বাসন নিশ্চিত করার সব রকম ব্যবস্থা করেছে সরকার। কিশোর সংশোধনালয়ে থাকার সময় দর্জির কাজ এবং রান্না করতে শিখেছিল ওই অপরাধী। মুক্তির পর তাকে একটি সেলাইয়ের দোকান খুলে দিতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ব্যবস্থা করা হয়েছে সেলাই মেশিনসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রীর। এ ছাড়া আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ‘নাবালক’ ধর্ষককে এককালীন ১০ হাজার টাকা দিয়েছে দিল্লি সরকার।
কেন্দ্রীয় শিশুকল্যাণমন্ত্রী মানেকা গান্ধী জানিয়েছেন, এখন প্রায় ২১ বছরের ওই ধর্ষককে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ছেড়ে দেওয়া হলেও তাকে সার্বক্ষণিক একটি নজরদারিতে রাখা হবে। অন্য নাগরিকদের মতো সমাজে মুক্ত স্বাভাবিকভাবে বিচরণ করার অধিকার সে পাবে না। তবে তাকে নতুন করে আইনের আওতায় আনার কোনো সুযোগ নেই।
মানেকা গান্ধী আরো জানান, নির্ভয়ার ওই ঘটনার পর ভারতে এখন এই আইনটি সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যাতে এই ছেলেটির মতো ঘৃণ্য অপরাধে যুক্ত কেউ এই আইনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দ্রুত বেরিয়ে আসতে না পারে।
ভারতের আইন অনুযায়ী, অপরাধ ঘটানোর সময়ে কারো বয়স ১৮-এর কম হলে তাকে তিন বছরের বেশি কারাদণ্ড দেওয়া যাবে না। এদের বিচার হবে কিশোর আইনে এবং তাকে আটকে রাখাও হবে কিশোর সংশোধনাগারে। নির্ভয়া গণধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের সময় ওই ছেলেটির বয়স ছিল ১৮ বছরের কয়েক মাস কম। আইনের এই সুযোগটির কারণেই ‘নাবালক’ ধর্ষক তিন বছর কারাভোগের পর মুক্তি পেল।
২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বর জ্যোতি সিংকে চলন্ত বাসে গণধর্ষণের পর বাস থেকে ছুড়ে ফেলে হত্যার ঘটনা ভারতসহ গোটা বিশ্বজুড়ে তোলপাড় সৃষ্টি করে। জ্যোতি আর তাঁর এক বন্ধু মিলে দক্ষিণ দিল্লির একটি সিনেমা হল থেকে বাসায় ফেরার উদ্দেশে বাসে উঠলে ছয়জন দুর্বৃত্ত তাঁদের আক্রমণ করে। বাসে ঘণ্টাব্যাপী ধর্ষণ ও নির্যাতনের পর জ্যোতিকে রাস্তার পাশে অর্ধমৃত অবস্থায় ছুড়ে ফেলা হয়।
জ্যোতিকে যখন উদ্ধার করা হয়, তখন তার পেটের নাড়িভুঁড়ি বেরিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু বেঁচে ছিলেন তিনি। বেঁচে থাকার জন্য তাঁর এই দুর্দান্ত সাহসিকতা দেখে তাঁর নাম দেওয়া হয়েছিল ‘নির্ভয়া’। প্রথমে দিল্লিতে এবং পরে সিঙ্গাপুরে ১৩ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াইয়ের মারা যান তিনি।
২০১২ সালের এই বর্বরোচিত ধর্ষণের ঘটনা যখন জানাজানি হয়, তখন ভারতের রাজধানীর রাস্তায় নেমে এসেছিলেন হাজার হাজার প্রতিবাদী মানুষ। এমনকি ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যখন আদালতে এই মামলার বিচারকাজ চলছিল, তখন এই ধর্ষকদের ফাঁসির দাবিতে উত্তাল ছিল ভারতবাসী। কিন্তু বিচারের সব আবেদন ম্লান করে দিয়ে ‘আইনের ফাঁক গলে’ বেরিয়ে গেল ‘নাবালক’ ধর্ষক।