চেটিয়া ফিরতেই শান্তি আলোচনার উদ্যোগ

আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) সঙ্গে শান্তি আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে ভারত সরকার। সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া ভারতে ফিরে যাওয়ার পর দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে এই উদ্যোগের কথা জানিয়েছে টাইমস অব ইন্ডিয়া।
এদিকে আলোচনায় আগ্রহী উলফার একটি অংশের জ্যেষ্ঠ নেতারা জানিয়েছেন, এই মাসের শেষে তাদের দিল্লিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। গত ৬ নভেম্বর ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী কিরেন রিজেজু সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, ‘দীপাবলির পরে আমরা উলফার সঙ্গে আলোচনায় বসব।’
সূত্রের উল্লেখ করে টাইমস অব ইন্ডিয়া আরো জানায়, বিজেপি নেতৃত্বাধীন সরকার উলফার সঙ্গে ২০১৬ সালের আসাম বিধানসভা নির্বাচনের আগে ‘সমঝোতায়’ যেতে আগ্রহী। আগামী ২৪ নভেম্বর দিল্লিতে এ আলোচনা শুরু হওয়ার কথা বলেও জানিয়েছে পত্রিকাটি।
২০১১ সালে দলের চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়ার নেতৃত্বে ভারত সরকারের সঙ্গে এই শান্তি আলোচনা শুরু হয়েছিল। শুরু থেকেই উলফাপ্রধানের দাবি ছিল, দলের সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়াকে দেশে ফিরিয়ে আনা ও মুক্তি দেওয়া।
অনুপ চেটিয়াকে ভারতে আনার ক্ষেত্রে কূটনৈতিক তৎপরতার ঘাটতির অভিযোগ করে বিভিন্ন দাবি মীমাংসা করতে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দিয়েছিল আসামের এই বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি।
শেষ পর্যন্ত অনুপ চেটিয়াকে ভারতের হাতে হস্তান্তর করায় শান্তি আলোচনার পক্ষের উলফার শীর্ষ নেতারা খুশি। দলের ভাইস চেয়ারম্যান প্রদীপ গগৈ জানিয়েছেন, ‘চেটিয়ার ঘরে ফেরা শান্তি আলোচনার ক্ষেত্রে সম্পদ। দীর্ঘদিন পরে তিনি ফিরে এসেছেন, এবার তাঁকে কাছে পাওয়া গেলে আমরা আনন্দিত হব।’
বাংলাদেশ থেকে উলফার প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়াকে ফিরিয়ে নেওয়ার পরে সভাপতি অরবিন্দ রাজখোয়ার নেতৃত্বাধীন অংশের প্রধান দাবি ছিল সরকারের সঙ্গে শান্তি আলোচনা শুরু করা। উলফার এই অংশটি এরই মধ্যে নিজেদের দাবিনামা সরকারের কাছে জমা দিয়েছে।
সূত্রের উল্লেখ করে পত্রিকাটি জানায়, উলফা এরই মধ্যে ‘স্বাধীন আসামের’ দাবি থেকে সরে এসেছে। এর পরিবর্তে আসামে অধিক স্বায়ত্তশাসনের ওপর জোর দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে তাদের। ভারতীয় সংবিধানের মধ্যে থেকেই আসামের জনগণের অধিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানাবে তারা।
উলফার সামরিক শাখার এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা টাইমস অব ইন্ডিয়াকে জানান, ‘সাধারণ সম্পাদককে ভারতে ফিরিয়ে আনা, এটা ছিল আমাদের প্রধান দাবি। আমরা আনন্দিত যে, তাঁকে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। কিন্তু আমরা জেনেছি তাঁর ( অনুপ চেটিয়া) বিচার শুরু হবে। এর অর্থ হচ্ছে, তিনি শান্তি আলোচনায় বসতে পারবেন না। সরকার যদি এমন পদক্ষেপ নেয় সেটি হবে বিশ্বাসঘাতকতা।’ সাধারণ সম্পাদক ছাড়া শান্তি আলোচনা সম্ভব হবে না বলেও জানান উলফা নেতা।
পত্রিকাটি আরো জানায়, এরই মধ্যে অনুপ চেটিয়ার ভারতে ফিরে আসা নিয়ে আসামে সরকার ও বিরোধী দলের মধ্যে তর্ক শুরু হয়েছে। বিজেপি সরকারের দাবি, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উদ্যোগ ও বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের কারণে চেটিয়াকে ভারতে ফিরিয়ে আনা গেছে। কিন্তু আসামের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার দাবি করছে, তারা চেটিয়াকে ফিরিয়ে আনতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করে আসছে।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে ফেরত পাঠানোর পর গত বৃহস্পতিবারই অনুপ চেটিয়ার স্ত্রী মণিকা চেটিয়া ছেলেমেয়েসহ দিল্লিতে গিয়েছেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। মণিকার দাবি, গত ১৬ বছর তাঁর সঙ্গে অনুপের দেখা হয়নি। অনুপের ছেলে বুমনি চেটিয়া জানিয়েছেন, বাবা যখন ঘর ছেড়েছিলেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ৫ বছর।
উলফার সাবেক কমান্ডার মৃণাল হাজারিকা জানিয়েছেন, মুক্তি পেলে অনুপ চেটিয়া কূটনীতিকভাবে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেবেন।
উলফার সদস্য ও অনুপ চেটিয়ার পরিবারের আশা, দলটির চেয়ারম্যান অরবিন্দ রাজখোয়া, ভাইস চেয়ারম্যান প্রদীপ গগৈ, পররাষ্ট্রসচিব শশধর চৌধুরী, অর্থসচিব চিত্রবর্ণ হাজারিকাসহ দলের নেতাদের বাংলাদেশ সরকার ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার পর যেভাবে কিছুদিনের মধ্যেই জামিন দেওয়া হয়েছিল, অনুপ চেটিয়ার ক্ষেত্রেও তা করা হবে।
উলফার আলোচনাপন্থী নেতাদের মতে, অনুপ চেটিয়ার উপস্থিতিতে দলের সামরিক শাখার প্রধান পরেশ বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন কট্টরপন্থী অংশের সঙ্গে আলোচনাপন্থীদের যে ব্যবধান তৈরি হয়েছে, তা কাটানো সম্ভব হবে। কট্টরপন্থী পরেশ বড়ুয়া ২০০৯ সালে উলফার ঘাঁটি আসাম থেকে সরিয়ে মিয়ানমারে নিয়ে যান। চীনেও তাঁর যাতায়াত রয়েছে বলে ভারতীয় গোয়েন্দাদের ধারণা। সেখান থেকেই তিনি উলফার আলোচনাপন্থী নেতাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নতুন সংগঠন গড়েছেন এবং আসামে নাশকতা চালানোর চেষ্টা করছেন। তবে তাঁকে নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য অনুপ চেটিয়াকে কাজে লাগানো হতে পারে বলে জানা গেছে।
আসামের পুলিশপ্রধান খগেন শর্মা জানিয়েছেন, অনুপ চেটিয়ার বিরুদ্ধে খুন, চাঁদাবাজিসহ আটটি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া তাঁর বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবাদবিরোধী আইনেও মামলা রয়েছে, যার কার্যক্রম গুয়াহাটির বিশেষ আদালতে চালানো হচ্ছে।
১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর মোহাম্মদপুর তাজমহল রোডের একটি বাসা থেকে অনুপ চেটিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই সময় তাঁর কাছ থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট, স্যাটেলাইট টেলিফোন ও বৈদেশিক মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছিল। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি তাঁর বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মোহাম্মদপুর থানায় ‘ফরেন কারেন্সি অ্যাক্টে’ একটি মামলা দায়ের করে। পরে পাসপোর্ট অ্যাক্ট ও স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্টে আরো তিনটি মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। এসব মামলায় আদালত তাঁর বিরুদ্ধে জরিমানাসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন।
অনুপ চেটিয়ার প্রথম পর্যায়ের কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হয় ২০০৩ সালের ২৫ আগস্ট। চারটি মামলায় ১১ হাজার টাকা জরিমানা পরিশোধ না করায় আরো দেড় বছর কারাদণ্ড ভোগ করেন তিনি। সে হিসাবে তাঁর কারাদণ্ডের মেয়াদ ছিল ২০০৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এরপর বাংলাদেশ সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে ‘দণ্ডহীন বন্দি’ হিসেবে কারাগারে রাখা হয়। এ সময়ে তিনি জাতিসংঘের কাছে শরণার্থীর মর্যাদা চেয়েও আবেদন করেছিলেন।
১৯৭৯ সাল থেকে স্বাধীন আসামের দাবিতে প্রদেশটিতে সশস্ত্র আন্দোলন করছে উলফা। টাইমস অব ইন্ডিয়া জানায়, গত তিন দশক জুড়ে আসামে জাতিগত সহিংসতায় অন্তত ৫০০টি বোমার বিস্ফোরণ ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে প্রায় ১০ হাজার মানুষ।