সিনেমার গল্পকে হার মানানো হত্যাকাণ্ড

এ যেন বলিউডের সিনেমার গল্প। প্রেম-পরকীয়া, ভালোবাসা-যৌনতা, আবেগ, ধোঁকা-সবই আছে এখানে। আছে সিনেমার গল্পের মতোই উন্নতির সিঁড়ি ভেঙে তরতরিয়ে ওঠার কাহিনী। আছে পতন, নৃশংসতায় গা শিউরে ওঠার গল্পও।
যদিও বাস্তবের গল্পগুলো নিয়েই গড়ে ওঠে সিনেমার কাহিনী, তবু কিছু কিছু খুনের ঘটনা হার মানায় রুপালি পর্দার গল্পকেও। সে রকমই একটি খুনের ঘটনা নিয়ে সারা ভারতে চলছে তোলপাড়।
গল্পের শুরু
ঘটনার শুরু গত ২৫ আগস্ট। সেদিন নিজের মেয়ে শিনা বোরাকে হত্যার অভিযোগে ভারতের বৃহৎ মিডিয়া প্রতিষ্ঠান স্টার ইন্ডিয়ার সিইও পিটার মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী ইন্দ্রানীকে গ্রেপ্তার করে মুম্বাই পুলিশ। সেই ইন্দ্রানী, ২০০৮ সালে দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের সেরা ৫০ ভারতীয় নারী ব্যবসায়ীর তালিকায় যাঁর নাম এসেছিল।
সংবাদমাধ্যমে এ ঘটনা আসার পর চমকে উঠেছে ভারতবাসী। তবে এর পর থেকে ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছিল সবার কাছ থেকেই পাওয়া গেছে পরস্পরবিরোধী তথ্য।
ঘটনা এমন দাঁড়িয়েছিল, গত বুধবার তুমুল আলোচিত এই মামলাটির ব্যাপারে মিডিয়াকে দেওয়া এক বিবৃতিতে মুম্বাইয়ের পুলিশ প্রধান মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি বুঝতে পারছি না, এই মামলা নিয়ে সবাই মিথ্যাচার করছেন কেন?’
যাই হোক সকল মিথ্যা, ষড়যন্ত্রকে দূরে সরিয়ে চাঞ্চল্যকর এই খুনের মামলাটির ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার মুম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার রাকেশ মারিয়া জানিয়েছেন, মিডিয়া টাইকুন ইন্দ্রানী মুখোপাধ্যায় তাঁর অতীত প্রকাশের ভয়ে ২০১২ সালে নিজের মেয়ে শিনাকে শ্বাসরোধে খুন করেন।
এই তথ্য জানার পর আক্ষরিক অর্থেই আঁতকে উঠেছে মুম্বাইয়ের মিডিয়াপাড়াসহ সারা ভারত। কারণ সারা ভারত এতদিন ধরে জানত নিহত শিনা ইন্দ্রানীর বোন। এ ছাড়া পুলিশের দেওয়া খুনের ভয়াবহতার বর্ণনায় আঁতকে উঠেছে বিশ্বের সব স্বাভাবিক চিন্তার মানুষ।
কী ছিল ইন্দ্রানীর অতীত?
মুম্বাই পুলিশের দেওয়া বর্ণনা অনুযায়ী ইন্দ্রানী মুখোপাধ্যায়ের আসল নাম পরী বোরা। আসামের এক মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে ছিলেন পরী। উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল আসামে সিদ্ধার্থ দাস নামে এক মডেল ও সংগীতজ্ঞের সঙ্গে। সেই সম্পর্কের ফলেই ১৯৮৬ সালে মাত্র ১৬ বছর বয়সে মেয়ে শিনার এবং এর দুই বছর পর ছেলে মিখায়েলের মা হন তিনি।
এরপর আসামের গোয়াহাটিতে মা দুর্গারানী বোরা ও বাবা উপেন্দ্রকুমার বোরার কাছে সন্তানদের রেখে ১৯৯০ সালে চলে আসেন কলকাতা। এখানে এসে নাম নেন ইন্দ্রানী। ১৯৯৩ সালে ইন্দ্রানী বিয়ে করেন সঞ্জীব খান্না নামে এক প্রযোজক-পরিচালককে। ১৯৯৪ সালে জন্ম নেয় ইন্দ্রানী-সঞ্জীবের মেয়ে বিধি।
আবার উড়াল পর্ব। স্বামী-সন্তান রেখে ২০০১ সালে ইন্দ্রানী চলে যান মুম্বাইয়ে, কাজ নেন একটি এইচআর ফার্মে, যার ক্লায়েন্ট আম্বানির রিলায়েন্স গ্রুপ। ২০০২ সালে সম্পর্ক হয় ওই প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তা পিটার মুখোপাধ্যারের সঙ্গে। এরপর কলকাতায় ফিরে ডিভোর্স দেন সঞ্জীবকে।
একই বছরের নভেম্বরে মেয়েকে সঙ্গে নিয়েই বিয়ে করেন পিটারকে। একই পছর পিটার রিলায়েন্স ছেড়ে স্টার ইন্ডিয়ার দায়িত্ব নেন। পরে ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠা করেন আইএনএক্স মিডিয়া। আর ইন্দ্রানী মুখোপাধ্যায় রাতারাতি বনে যান ভারতের মিডিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী সিইওর স্ত্রী।
মেয়ে যখন ছোট বোন
২০০৫ সালে আসামে ইন্দ্রানীর বাবার মৃত্যুর পর গোয়াহাটি থেকে শিনা ও মিখায়েল মুম্বাইয়ে চলে আসে। প্রথমে এক মাস মিখায়েল ও শিনাকে একটি হোস্টেলে রাখেন ইন্দ্রানী। এরপর স্বামী পিটারের সঙ্গে প্রেমিকের সন্তান শিনা ও মিখায়েলকে পরিচয় করিয়ে দেন নিজের ছোট ভাইবোন হিসেবে। মুম্বাইয়ের সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়তে পাঠান তাদের।
কেমন মানুষ ইন্দ্রানী
মিডিয়াপাড়ায় ইন্দ্রানী সম্পর্কে একটা কথা প্রচলিত আছে তিনি ‘গেঁয়ো তবে চতুর।’ কূটবুদ্ধিসম্পন্ন ও উচ্চাকাঙ্ক্ষী। সুনামও রয়েছে বেশ। ইন্দ্রানী বন্ধু অন্তঃপ্রাণ, দরাজ দিলের মানুষ। অত্যন্ত প্রভাবশালী ইন্দ্রানীর বিচরণ ছিল সমাজের বেশ উঁচুতলায়।
ইন্দ্রানীর সঙ্গে বিয়ের পর ২০০৬ সালে স্টার ইন্ডিয়া ছেড়ে আইএনএক্স মিডিয়া নামে একটি সংস্থা খোলেন পিটার। সেই সংস্থার সিইও ছিলেন ইন্দ্রানী। ২০০৭ সালে দুটি মিউজিক চ্যানেল শুরু করেন তাঁরা। ২০০৮ সালে নিউজএক্স খবরের চ্যানেল শুরু হয়। তবে শুরু থেকেই বিতর্ক সঙ্গী ছিল এ সংস্থার। ২০০৮-০৯ সালে সাংবাদিকদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অভিযোগ ওঠে, সংস্থা ছাড়েন প্রখ্যাত সাংবাদিক বীর সাংভি। তা ছাড়া ২০০৮-এর আর্থিক মন্দার সময় প্রচুর ক্ষতিও হয় সংস্থাটির। ২০০৯ সালেই সংস্থা বিক্রি করে বেরিয়ে যান মুখোপাধ্যায় দম্পতি। তবে বরাবরই মিডিয়াজগতে চূড়ান্ত প্রভাব খাটিয়ে এসেছেন তাঁরা। জাঁকজমক করে পার্টি দেওয়ার জন্য পরিচিত ছিলেন পিটার-ইন্দ্রানী।
দামি গাড়ি, মুম্বাইয়ের সবচেয়ে অভিজাত বান্দ্রা এলাকায় বাড়ি-সব মিলিয়ে সবারই সমীহ জাগাতেন হাই প্রোফাইল সিইওর স্ত্রী ইন্দ্রানী। কিন্তু গত কদিনের চমকপ্রদ ঘটনাপ্রবাহের জেরে মিডিয়াপাড়ায় এখন জোর ফিসফাস। কেউ মুখ খুলছেন না প্রকাশ্যে। তবে বলিউডের পরিচিত এক অভিনেত্রীর নাম উল্লেখ না করে তেহেলকা ডট কম জানায়, মুম্বাইয়ে যখন প্রথম আসেন তখন ভালো করে ইংরেজি পর্যন্ত বলতে পারতেন না। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিগত ১৫ বছরে তাঁর এই ধূমকেতুর মতো উত্থান, মিডিয়াজগতে চূড়ান্ত প্রভাবশালী হয়ে ওঠা, সব কিছুই তাঁর সম্পর্কে কিছুটা সন্দেহের জন্ম দিয়েছিল।
অতীত ঢাকতেই মেয়েকে খুন!
ইন্দ্রানীর অতীত নিয়ে খুব একটা কেউই জানতেন না। সবাই জানতেন কলকাতার মেয়ে তিনি। ২০০১ সালে পরিচয় হয় পিটার ও ইন্দ্রানীর। ২০০২ সালে বিয়ের সময় ইন্দ্রানী শুধুমাত্র সাবেক স্বামী সঞ্জীব খান্নার কথাই জানিয়েছিলেন পিটারকে। সিদ্ধার্থ দাস বা তারও আগে শিনা যাঁর ঔরসজাত সন্তান সেই ব্যক্তির সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও কিছু তাঁকে জানানো হয়নি বলে দাবি পিটারের। সঞ্জীবের সঙ্গে ডিভোর্সের পর মুম্বাই চলে যান ইন্দ্রানী, সেখানে পিটারের সঙ্গে বিয়ে। তবে পরবর্তীকালে সঞ্জীবের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন তিনি। সঞ্জীব-ইন্দ্রানীর সন্তান বিধির কথা পিটার শুধু জানতেনই না, তাকে দত্তকও নিয়েছিলেন। পারিবারিক সূত্রের বরাতে দ্য হিন্দু জানায়, বিধিকে খুব ভালোবাসেন পিটার। তবে ইন্দ্রানীর কারণে নিজের প্রথম পক্ষের সন্তান রাহুলের সঙ্গে তীব্র বিরোধ হয় পিটারের।
হতভম্ব স্বামীর বক্তব্য
সাংবাদিক থেকে জনপ্রিয় টিভি অভিনেতা, সবাই মুখ দেখাতে উৎসুক থাকতেন সেখানে। তবে অপরাধের সঙ্গে স্ত্রী যে এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছেন, তা ভাবতে পারেননি বলেই দাবি করছেন পিটার। হতভম্ব পিটারের এখন বক্তব্য, ‘১৫ বছর ধরে আমার বিয়ের বিরাট অংশ সম্পর্কে আমায় অন্ধকারে রাখা হয়েছে। ইন্দ্রানীকে আমি বিশ্বাস করতাম। ওকে সন্দেহ করা বা ওর দাবি পরীক্ষা করে দেখার কথা মনেও আসেনি।’
শিনার প্রেমিক ও ভাই রাহুল
শিনা বোরা হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পিটার মুখোপাধ্যায়ের ছেলে রাহুলকে জেরা করছে পুলিশ। বৃহস্পতিবার সকালে মুম্বাইয়ের খার পুলিশ স্টেশনে রাহুলের জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়। এতে শিনার সৎভাই রাহুল অকপটে স্বীকার করেছেন শিনার সঙ্গে প্রণয়ের সম্পর্ক ছিল তার। রাহুল আরো জানিয়েছে ২০০৫ সালে কলেজে পড়ার সময় সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন দুজনে। ঘটনার সময় তাঁদের সম্পর্ক ছিল সাত বছরের পুরোনো। তবে প্রথম থেকেই এই সম্পর্ক পছন্দ ছিল না ইন্দ্রানীর।
আর ইন্দ্রানী মুখোপাধ্যায় স্বীকার করেছেন, ওই সম্পর্ক তিনি মেনে নিতে পারেননি। তাই শিনা মানে নিজের মেয়েকে খুন করেছেন তিনি। গোটা ঘটনায় ধীরে ধীরে ‘অনার কিলিং’ তত্ত্বই খুঁজে পাচ্ছে পুলিশ।
যেভাবে খুন হন শিনা
তিন বছর আগে চলন্ত গাড়িতে শ্বাসরোধে খুন করা হয় শিনাকে। সাবেক স্বামী সঞ্জীব খান্নার সহায়তায় খুনটি করেন ইন্দ্রানী। খুনের পর রায়গড়ের একটি গ্রামে দেহ ফেলে তা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। ঘটনাস্থল চিহ্নিত করেছেন ইন্দ্রানীর গাড়িচালক শ্যাম রাই।
পুলিশ তদন্তে জানতে পেরেছে, ২০১১ সালে শিনা রিল্যায়েন্স মুম্বাই মেট্রোয় চাকরিতে যোগ দেন। কিন্তু কয়েক মাস পর থেকে তিনি অফিস যাওয়া বন্ধ করে দেন। তারপর ২০১২ সালে একটি রেজিগনেশন লেটার পাঠানো হয় শিনার ই-মেইল থেকে। ওই মেইল শিনাই করেছিলেন, নাকি অন্য কেউ, তা খতিয়ে দেখছে পুলিশ।
২০১২ সালের ২৪ এপ্রিল শিনাকে ফোন করেন ইন্দ্রানী। জানান, তাঁর সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে, বান্দ্রায় ন্যাশনাল কলেজের সামনে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় দেখা হবে। এরপর ওই কলেজের সামনে থেকে শিনাকে নিজের গাড়িতে তোলেন ইন্দ্রানী। গাড়িতে ছিলেন ইন্দ্রানীর সাবেক স্বামী সঞ্জীব খান্না এবং চালক শ্যাম রাই। গাড়ি রওনা দেয় রায়গড়ের উদ্দেশে। পথে গাড়ির মধ্যেই শিনাকে শ্বাসরোধে খুন করা হয়। খুন করেন ইন্দ্রানী ও সঞ্জীব। এরপর দেহ নিয়ে ঘণ্টা দুয়েক রাস্তায় ঘোরেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত রায়গড়ের পেন গ্রামে দেহ ফেলে পেট্রল দিয়ে জালিয়ে দেওয়া হয়।
এরপর ইন্দ্রানী সবাইকে বলতে থাকেন যে শিনা পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে গেছেন এবং ব্যস্ততার কারণে কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না। আবার শিনার মৃত্যুর পর শিনার এক জন্মদিনে গোয়ার একটি ছবিও পোস্ট করেন ইন্দ্রানী। যেখানে শিনাকে দেখা যাচ্ছে ছুটি কাটাতে।
এক বছর শিনা সেজে ছিলেন ইন্দ্রানী
এক বছর ধরে শিনা বোরা সেজে ফোন ব্যবহার করেছিলেন ইন্দ্রানী। করতেন এসএমএস, করতেন ই-মেল। আট ঘণ্টা জেরা শেষে এই তথ্য উদ্ধার করল পুলিশ। শিনা বেঁচে আছে এটা বোঝাতেই এসব করতেন ইন্দ্রানী। এমনটাই জানিয়েছেন মুম্বাইয়ের পুলিশ কমিশনার রাকেশ মারিয়া।
পিটারের প্রথম পক্ষের ছেলে রাহুলের সঙ্গে শিনার সম্পর্ক ছিল। নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পর রাহুলের কাছে ‘ব্রেক আপ’ চেয়ে একটি মেসেজ আসে শিনার ফোন থেকে, এ কথা আগেই জানিয়েছিলেন রাহুল। পাশাপাশি, শিনার খোঁজ করতে গেলে রাহুলকে পিছু ছাড়তে বলেন ইন্দ্রানী। এই মেসেজ যে ইন্দ্রানী নিজেই করেছিলেন, তা মোটামুটি নিশ্চিত পুলিশ। তবে এখানেই শেষ নয়, শিনার অফিসে ও ভাড়া বাড়ির বাড়িওয়ালাকে শিনার সই নকল করে চিঠি লিখেছিলেন ইন্দ্রানী, এমনটাও জানতে পেরেছে পুলিশ।