নলছিয়ার ঘাট
পর্যটন সম্ভাবনার জানালা

ভোরের আলো ফুটতেই ব্রহ্মপুত্রের তীরে শুরু হয় হাক-ডাক। বেড়ে যায় নৌকার আনাগোনা, জমে ভিড়। কেউ শাকসবজি, ধান বা চর থেকে আনা ফসল নিয়ে জামালপুরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন, আবার কেউ জামালপুর থেকে এসেছেন বাজার সওদা বা আপনজনের খোঁজে। এই আসা যাওয়ার ভিড়েই গড়ে উঠেছে গাইবান্ধার সাঘাটার হলদিয়া ইউনিয়নের নলছিয়া ঘাটের প্রাণচাঞ্চল্য।
শুধু তাই না সকালবেলার ব্যস্ততা কাটতে না কাটতেই বদলে যায় দৃশ্যপট। দুপুরের দিকে এখানে ভিড় জমে নৌভ্রমণে আসা তরুণ-তরুণী কিংবা পরিবার-পরিজনের। নৌকা ভাড়া নিয়ে গান-বাজনায় রঙিন হয়ে যায় নদীর বুক।
তাই নলছিয়ার ঘাট কেবল কৃষিপণ্য বা যাতায়াতের পথ নয়, বরং ব্যবসা আর বিনোদনের এক অন্যন্য জায়গা। যথাযথ পরিকল্পনা পেলে এই ঘাট হতে পারে উত্তরাঞ্চলের এক সম্ভবনাময় পর্যটনস্পট।

কৃষি আর চরের যোগসূত্র
গাইবান্ধার সাঘাটা উপজেলা ও আশপাশের গ্রাম ধান, পাট, ভুট্টা আর মরিচ চাষের জন্য পরিচিত। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ব্রহ্মপুত্রের বিস্তৃত চরাঞ্চল। এসব চরে জন্ম নেয় প্রচুর শাকসবজি।
কিন্তু বড় বাজারে এসব পণ্য পৌঁছানোর সহজ উপায় ছিল না আগে। নলছিয়ার ঘাট সেই পথ খুলে দিয়েছে। চর থেকে কৃষকরা নৌকায় করে পণ্য এনে ভিড়েন ঘাটে। এখান থেকে পাইকাররা পণ্য ট্রাকে করে নিয়ে যান বগুড়া, গাইবান্ধা হয়ে ঢাকায়। এছাড়া এ উৎপাদিত পণ্য জামালপুরের ইসলামপুর বা দেওয়ানগঞ্জ হয়েও পৌছে যায় ঢাকায়।
চরের কৃষক হাফিজুর রহমান। এ বিষয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। তিনি বললেন, “আগে চর থেকে বাজারে নিতেই কষ্ট হতো। এখন নৌকায় মাল আনি ঘাটে, সেখান থেকে ট্রাকে চলে যায় ঢাকাসহ বড় বড় বাজারে। এতে আমাদের চাষাবাদ যেমন বেড়েছে আয়ও তেমন বেড়েছে।”
স্থানীয়রা জানায়, নলছিয়ার ঘাট গ্রামের কৃষকদেরও জীবন সহজ করেছে। নৌপথে ভাড়া কম হওয়ায় পরিবহন খরচ অর্ধেকেরও বেশি সাশ্রয় হয়। ফলে কৃষকরা তাদের ফসল ভালো দামে বিক্রি করতে পারছেন। আর এভাবেই নলছিয়ার ঘাট কৃষি অর্থনীতির এক কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।
ভ্রমণের নতুন গন্তব্য
বাণিজ্যের পাশাপাশি নলছিয়ার ঘাট এখন বিনোদনেরও জায়গা। বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিবার-পরিজন দল বেঁধে আসে নৌভ্রমণে।
নদীর বুক চিরে চলা নৌকায় গান, হাসি, আড্ডা সব মিলিয়ে মুহূর্তগুলো হয়ে ওঠে উৎসবমুখর। শীতেতো এ ঘাটে পিকনিকের ধুম লেগে যায়। স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা, সামাজিক সংগঠন বা বন্ধুবান্ধবের দল সারাদিন নৌকায় খাওয়া-দাওয়া আর আনন্দে কাটিয়ে দেন।
স্থানীয় সামাজিক সংগঠক এম এম মেহেরুল ইসলাম জানায়, ‘নৌকা ভ্রমণের কথা উঠলেই মানুষ চলে জায় নলছিয়ার ঘাটে। নৌকা ভাড়াও কম। আবার নৌকায় চরে নির্জন চড়ে গিয়ে পিকনিক করাও অনেকটা মজার’।

গ্রামীণ খাবারের টান
নলছিয়ার ঘাটের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এখানকার গ্রামীণ খাবার। খুব অল্প টাকায় ভাত, মাসকালাইয়ের ডাল, আলুভর্তা, শুটকি ভর্তা, মৌসুমি শাকসবজি ও নদীর মছের চচ্চড়ি পাওয়া যায়। তবে এখানে হোটেল তেমন একটা গড়ে ওঠেনি। তিন চারটা ছোট ছোট ঝুপড়ি হোটেল রয়েছে।
স্থানীয় শিক্ষক আশরাফুল আলম বলেন, “এখানে খাওয়ার স্বাদই আলাদা। গ্রামীন পরিবেশে মাটির চুলায় রান্না। দোকানে খাবার খুব বেশি থাকে না, অল্প পরিমানে রান্না হয়ে থাকে। তবে খুব তৃপ্তি ভরে খাওয়া যায়। মনে করেন মাত্র ৪০ টাকায় আপনি আয়েশ করে দুপুরের খাবার খেতে পারবেন।”
প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য
নলছিয়া ঘাটের সৌন্দর্য মনকে ছুঁয়ে যায়। ভোরবেলা সূর্য ওঠার দৃশ্য, সন্ধ্যায় নদীর জলে লাল-সোনালি আভা সবকিছু মিলিয়ে এটি এক প্রাকৃতিক অপূর্ব দৃশ্যপট।
নলছিয়া ঘাটে কথা হয় নৌকার মাঝি শরিফুল ইসলাম প্রামাণিকের সঙ্গে। তিনি জানান, এ ঘাটে প্রতিনিয়ত দুইটা নৌকা যাতায়াত করে জামালপুরে। এছাড়াও ছোত ছোত চরের সংগে সংযোগ স্থাপণের জন্য আরও বেশকিছু নৌকা রয়েছে। এগুলোই ভারা নিয়ে অনেকে নদীতে নৌকা ভ্রমণ করেন।

পর্যটনের সম্ভাবনা
বর্তমানে ঘাটে সরকারি বা বেসরকারি কোনো বিশেষ উদ্যোগ নেই। অথচ এখানকার সৌন্দর্য, কৃষিপণ্য, চরাঞ্চলের জীবন, নৌভ্রমণ আর খাবার—সব মিলিয়ে এটি হতে পারে পর্যটনের অন্যতম কেন্দ্র।
এসব উৎরায়ে স্থানীয়দের ধারণা, সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগে নলছিয়ার ঘাট একদিন শুধু সাঘাটা নয়, সমগ্র দেশের পরিচিত পর্যটনকেন্দ্র হয়ে উঠতে পারে।