ফুড ট্রাভেলিং
স্বাদের খোঁজে ভ্রমণ

ভ্রমণ মানেই নতুন জায়গা দেখা, নতুন সংস্কৃতি জানা। কিন্তু সেই ভ্রমণ পূর্ণতা পায় না যদি স্থানীয় খাবারের স্বাদ নেওয়া না হয়। সারা পৃথিবীতে এখন ফুড ট্রাভেলিং একটি বড় ট্রেন্ড। ইউরোপের ইতালিয়ান পাস্তা, জাপানের সুশি, তুরস্কের কাবাব কিংবা বাংলাদেশে ও ভারতের বিরিয়ানি সবই পর্যটকদের কাছে অদ্বিতীয় অভিজ্ঞতা।
ঠিক তেমনি বাংলাদেশেও রয়েছে এমন কিছু খাবার, যেগুলোর স্বাদে শুধু দেশের মানুষই নয়, বিদেশিরাও মুগ্ধ। তার মধ্যে অন্যতম বগুড়ার দই আর ভোলার মহিষের দই।
বগুড়ার দই : মিষ্টতার এক অনন্য ইতিহাস
বাংলাদেশে দইয়ের ইতিহাস অনেক পুরোনো। তবে দইয়ের আসল ব্র্যান্ড বলা হয় বগুড়ার দইকে। দইয়ের জন্য বগুড়া এমন খ্যাতি পেয়েছে যে, দেশ-বিদেশের মানুষ একে আলাদা করে চেনে।
বগুড়ার দই বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত বগুড়া জেলার বিখ্যাত মিষ্টান্ন। ২০২৩ সালে বগুড়ার সরার দই ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
বিশেষত্ব
ঘন দুধকে ধীরে ধীরে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয়।
মাটির হাঁড়িতে জমিয়ে রাখা হয়, যা বাড়তি স্বাদ আনে।
মিষ্টির পরিমাণ ও দুধের ঘনত্বের অনুপাতে তৈরি হয় এক অদ্বিতীয় স্বাদ।
ইতিহাস
ধারণা করা হয়, নবাব আমলের সময় থেকেই বগুড়ার দইয়ের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। মিষ্টান্ন হিসেবে এটি ঢাকার আভিজাত্যপন্থী ঘরানার খাবার টেবিলেও জায়গা পায়।
ভোলার মহিষের দই : একেবারে ভিন্ন স্বাদ
বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল ভোলার বিশেষত্ব মহিষের দই। দ্বীপজেলা ভোলার তেমনই বিখ্যাত খাবার মহিষের দুধের টক দই। যা এই জেলাকে উপস্থাপন করেছে দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও।
ভোলার টক দইয়ের নাম জানা নেই এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবার কাছেই প্রিয় এই দই। ভোলায় পারিবারিক, সামাজিক বা সাংস্কৃতিক যেকোনো অনুষ্ঠানে দই থাকবে না এমনটা হতেই পারে না। ছোট, বড় যেকোনো অনুষ্ঠানে এ খাবার তুঙ্গে। স্থানীয়রা খাবারের শেষে ভাতের সঙ্গে দই খায়। তবে নানাভাবে খাওয়া যায় এই দই। নাস্তা হিসেবেও দই খাওয়া যায়। দই চিড়ার সঙ্গে হালকা মুড়ি ও চিনি মিশিয়ে মজা করে খাওয়া যায়। গরমের মৌসুমে দইয়ের সঙ্গে হালকা পানি ও চিনি মিশিয়ে ঘোল তৈরি করা হয়। এ ঘোল গরমের দিনে মানবদেহকে ঠাণ্ডা রাখে।
শুধু স্বাদেই দই সীমাবদ্ধ নয়। এই দইয়ে রয়েছে প্রচুর ঔষধি গুণ। হজমে সহায়তা করে দই। স্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, দইয়ে ক্যালসিয়াম, প্রোটিন, ভিটামিনসহ অন্যান্য উপদান রয়েছে, যা আমাদের দেহের জন্য খুবই উপকারি।
বহু বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন দইয়ের কারিগর আলহাজ মো. হাফেজ নুরুজ্জামানের সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, আসলে এ দই তৈরিতে তেমন কোনো কেরামতি নেই। এটা কঠিন কোনো বিষয় না। একটু খেয়াল করলেই দই তৈরি করা সম্ভব। তিনি মুহূর্তেই বর্ণনা দিলেন।
প্রথমে একটি মাটির পাত্র (টালি) পরিষ্কার করে নিতে হবে। এরপর দুধগুলোকে ভালোভাবে ছেকে মাটির পাত্রে স্থির জায়গায় রেখে দিলে হয়ে যাবে মুখরোচক টক দই। গরমের দিনে সাত থেকে আট ঘণ্টা এবং শীতের দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা সময় লাগে দই তৈরিতে।
ভোলায় বিভিন্ন ছোট-বড় বহু চর রয়েছে। এসব কারণে এখানে মহিষ পালন করা অনেকটা সুবিধাজনক। প্রায় ২০০ বছরের বেশি সময় ধরে এ মহিষের দুধের দইয়ের সুনাম রয়েছে এ জেলার।
কোথায় পাওয়া যায়
ভোলা পৌর শহরের ঘোষপট্টি মহিষের দুধের দইয়ের প্রধান প্রাণকেন্দ্র। এ ছাড়াও শহরের খলিফা পট্টি মসজিদ, দিদারের গলিসহ বিভিন্ন পয়েন্টে এবং জেলার বিভিন্ন উপজেলায় এ দই পাওয়া যায়।
কেমন দামে বিক্রি হয় এ দই
মহিষের দুধের দই সাধারণত মাটির পাত্রে (টালিতে) বসানো হয়। সে অবস্থায় উপরে শুধু পেপার দিয়ে মুড়িয়ে দেওয়া হয়। দুই ধরনের পাত্র থাকে। একটি দেড় লিটার, আরেকটি দুই লিটার। অবশ্য দুধের দামের উপর দইয়ের বাজার ওঠা-নামা করে।
বিশেষত্ব
দুধ আসে মহিষ থেকে, যা সাধারণ গাভীর দুধের তুলনায় অনেক বেশি ঘন ও ফ্যাটযুক্ত।
স্বাদে এটি আরও গাঢ়, ক্রিমি এবং মুখে লেগে থাকার মতো মোলায়েম।
সাধারণত গ্রামীণ বাজারেই পাওয়া যায়, তবে সাম্প্রতিক সময়ে এর কদর শহরেও বাড়ছে।
সংস্কৃতির সাথে মিশে থাকা
ভোলার স্থানীয় উৎসব, অতিথি আপ্যায়ন কিংবা পারিবারিক আয়োজনে এই দই অপরিহার্য হয়ে উঠেছে।
আপনি যদি ভ্রমণপিপাসু হন, তাহলে বগুড়া গিয়ে প্রথমবার আসল দই খেতে পারেন। তাহলে আপনার চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে যাবে।
আবার কিছুদিন পর ভোলায় গিয়ে মহিষের দই চেখে দেখতে পারেন। দুধের ঘনত্ব আর মোলায়েম স্বাদে আপনি মুগ্ধ হতে পারেন। ফেরার পথে আপনার মনে হতে পারে, বিদেশে যাওয়া ছাড়াই কেবল বাংলাদেশ ঘুরলেই কত অজানা স্বাদের সন্ধান পাওয়া যায়।