ইতিহাসের নীরব সাক্ষী কলম্বো সাহেব সমাধি

ঢাকার সূত্রাপুরের ওয়ারীতে দাঁড়িয়ে আছে এক অচেনা-অজানা সমাধি। নাম তার কলম্বো সাহেব সমাধি। খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্রের ভেতর অবস্থিত এই স্থাপনাটি বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায় কে এই কলম্বো সাহেব?
রহস্যময় সমাধি
খ্রিস্টান সমাধিক্ষেত্রে ছয় ধরনের সমাধি আছে। তার মধ্যে ‘এফ’ টাইপ সমাধির একটি হলো কলম্বো সাহেবের। তিনটি কবরের সমন্বয়ে গড়া এই স্থাপনাকে ব্রাডলি বার্ট বর্ণনা করেছিলেন এভাবে:
"It stands namelessly, dominating the whole cemetery and jealously keeping watch over the three graves that lie within."
অর্থাৎ নামহীনভাবে দাঁড়িয়ে আছে সমাধিটি, যেন পাহারা দিচ্ছে তার ভেতরে শুয়ে থাকা তিনটি কবরকে।
ইতিহাসে অস্পষ্ট পরিচয়
১৮২৪ সালে কলকাতার বিশপ হেবার ঢাকায় এসে নারিন্দার খ্রিস্টান কবরস্থান পরিদর্শন করেন। তখন কেয়ারটেকার তাঁকে জানান, এটি কলম্বো সাহেব নামের এক ব্যক্তির সমাধি। তিনি ছিলেন কোম্পানির চাকুরে। কিন্তু এর বাইরে আর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
পরে ১৯১৭ সালে Bengal Past and Present সাময়িকীতে প্রকাশিত ওয়াল্টার কে ফারমিঙ্গারের নিবন্ধেও নারিন্দার সমাধিগুলোর তালিকা ছাপা হলেও, কলম্বো সাহেবের নাম সেখানে অনুপস্থিত।

এপিটাফের অনুপস্থিতি
সমাধির ভেতরে তিনটি কবর রয়েছে, কিন্তু কোনো কবরেই এপিটাফ নেই। অথচ একই কবরস্থানে কোম্পানির আরও কয়েকজন কর্মচারীর কবর পাওয়া গেছে যেমন নাথানিয়েল হল (মৃত্যু: ১৭২৫) ও নিকোলাস ক্লেরেম বল্টে (মৃত্যু: ১৭৫৫)। কিন্তু তাদের সমাধির এপিটাফ পাওয়া গেলেও কলম্বো সাহেবের ক্ষেত্রে এমন কোনো চিহ্ন পাওয়া যায়নি। ফলে ধারণা করা হয়, শুরু থেকেই তাঁর সমাধিতে কোনো এপিটাফ বসানো হয়নি।
স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্য
সমাধিটি মোঘল স্থাপত্যরীতিতে বর্গাকার আকারে নির্মিত। প্রতিটি দেয়ালে চারটি প্রবেশপথ ছিল। সামনে ছিল নকশা খচিত পিলার এবং একটি অষ্টভুজাকৃতির স্তম্ভ, যেখানে একটি পরীর ছবি খোদাই করা ছিল।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্থাপনার মূল কাঠামো ধ্বংস হয়ে গেছে। আজ যা অবশিষ্ট রয়েছে, তা নিছক ধ্বংসাবশেষ।

সংস্কারের উদ্যোগ
ওয়ারী খ্রিস্টান সেমেট্রি বোর্ড, ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ফর সেমেট্রিজ ইন সাউথ এশিয়া (BSCSA) ও কমনওয়েলথ হেরিটেজ ফাউন্ডেশনের (CHF) সহযোগিতায় বর্তমানে সমাধিটির সংস্কার কাজ চলছে। মুরিশ গেটওয়ে ও কলম্বো সাহেব সমাধি পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে প্রকল্পের প্রথম ধাপ সম্পন্ন হয়েছে। দ্বিতীয় ধাপের কাজও শুরু হবে শিগগিরই।
অজানা এক গল্প
১৭২৪ সালে সমাহিত হয়েছিলেন জনৈক কলম্বো সাহেব। কে ছিলেন তিনি? কেন তাঁর কবর আজও নামহীন? এ প্রশ্নের উত্তর ইতিহাস দিতে পারেনি। শুধু জানা যায়—কোনো এক সময় তিনি কোম্পানির চাকুরে ছিলেন, আর ঢাকার মাটিতে তাঁর শেষ নিঃশ্বাস মিশে আছে।
কবরের ভেতরে শূন্য সমাধিগুলো আজও যেন ফিসফিস করে বলে—
“আমি কলম্বো সাহেব… নামহীন হলেও ইতিহাসের নীরব সাক্ষী হয়ে আছি।”