অর্থনীতি
কেমন হচ্ছে ঈদ বাণিজ্য?

ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদ মানেই উৎসব। মুসলমানদের জন্য বছর ঘুরে দুটি ঈদের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। তার মধ্যে ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে দেশের উৎসবের তালিকায় সবচেয়ে বড় ও গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হলো এ রমজানের ঈদ। কারণ এ ঈদকে কেন্দ্র করে সারা দেশের সার্বিক অর্থনীতি অন্যরকম চাঙ্গা থাকে প্রায় মাস খানেক। এ সময়ে দেশে প্রায় ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার ঈদ বাণিজ্য সংঘটিত হয়। কোথা থেকে আসে এ টাকা! তার উৎসই বা কী! এ নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। কিন্তু একটু আলোকপাত করলে তা সবার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে।
প্রথমে আমরা সম্ভাব্য আয়ের খাতগুলো চিহ্নিত করতে পারি। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত কর্মজীবীদের ঈদ বোনাস। এফবিসিসিআইএর তথ্যমতে, ৩২ হাজার কোটি টাকার ঈদ বোনাস বিলি করা হয় ঈদকে ঘিরে। সে জন্যই হয়তো ঈদকে নতুনভাবে জাতির কাছে উপস্থাপনের জন্য প্রতিবারের মতো এবারও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৩২ হাজার কোটি টাকার নতুন নোট বাজারে ছেড়েছে। এখন দেশের কৃষি উন্নয়ন অন্য যেকোনো সময়ের তুলনায় অত্যন্ত ভালো। সে জন্য কৃষক কর্তৃক তার উৎপাদিত পণ্যের মধ্যে নিত্যব্যবহারের অতিরিক্ত কিছু পণ্য ঈদের আগে বিক্রির জন্য বাড়িতে রেখে দেওয়া কৃষিপণ্য হতে আয়, জাকাত ও ফিতরা হতে দরিদ্র মানুষের আয়, ঈদী ও বকশিস হতে আয়, বিদেশ থেকে আগত রেমিটেন্স, পরিবহন ব্যবসা থেকে আয়, পর্যটন ও ভ্রমণ থেকে আয়, ঈদের জন্য পূর্ব থেকে নিজের কাছে জমানো অর্থ, এমনকি দালালি, ঘুষ, দুর্নীতি, চাঁদাবাজি, কালোবাজারি, ছিনতাই-রাহাজানির, মানুষ ঠকানোর মাধ্যমেও অনেকে অবৈধ পন্থায় অর্থ উপার্জন করে থাকে। সর্বোপরি প্রয়োজনে ধার-দেনা করে হলেও উৎসব পালন করার প্রবণতা তো বাঙালি মাত্রেই রয়েছে। ঈদের বাজারে মাত্র দুটি পার্টি থাকে- একটি ক্রেতা, আরেকটি বিক্রেতা। স্থান ও জীবিকাভেদে ঘুরেফিরে ক্রেতারাই বিক্রেতা, আবার বিক্রেতারাই ক্রেতা।
এই ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝেই হাজার হাজার কেটি টাকার বাণিজ্য হয়ে থাকে। কাজেই ঈদবাজারে সবার আয়ের সবগুলো টাকাই বাণিজ্যে চলে আসে। এবার আসা যাক খরচের খাতে। ব্যবসায় বিনিয়োগ, যেমন মালামাল ক্রয়, পরিবহন খরচ, দোকান ভাড়া, ঈদ উপলক্ষে দোকান ও বিপণিবিতানগুলোর বাড়তি সৌন্দর্যবর্ধনের জন্য আলোকসজ্জাকরণ, ডেকোরেশন, বাড়তি সেলসম্যান নিয়োগ করা, বিশেষ অফার দেওয়া, লটারি দিয়ে ক্রেতা আকর্ষণ করা ইত্যাদি। সে হিসেবে রমজান ঈদে ক্রেতাগণ ঈদের পোশাক-পরিচ্ছদ, জুতা, গৃহস্থালির জিনিসপত্রাদি, ইলেকট্রনিকসের জিনিসপত্র ইত্যাদি ক্রয়ে বেশি মনোযোগ দিয়ে থাকে। তা ছাড়া শৌখিন অনেকে বাড়িঘর সাজানোর জিনিসপত্রকেও সবিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কেউ কেউ আবার নিজের বাড়িঘরকে একটু রং করে নেওয়া, একটু-আধটু সংস্কার করে নেওয়া, বিয়েসহ অন্যান্য সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানাদিও সেরে নেয়। পত্রিকা খুললেই দেখা যায়, ঈদবাজারে ভারতীয়সহ বিদেশি পোশাকে ছেয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। এবার ভারতীয় পোশাকের তুলনায় দেশীয় হাতের কাজ করা থ্রিপিস, টাঙ্গাইল শাড়ি, বেনারসি কাতানের কদর বেশি। তাই গত বছরের মতো ভারতীয় টিভি চ্যানেলে প্রচারিত বিভিন্ন জনপ্রিয় মেগাসিরিয়ালের আদলে তৈরীকৃত পোশাক যেমন- পাখি, কিরণমালা ও গর্জিয়াসের তেমন কদর নেই।
এ ছাড়া ঈদের পোশাক হিসেবে মেয়েদের কাছে বেশি পছন্দ সারারা, বাজিরাও মাস্তানি, মাসাককালি ইত্যাদি। আর ছেলেদের পছন্দ হলো- আড়ংয়ের পাঞ্জাবি, সুলতান, ক্যাজুয়াল, কিউজি, বোম্বে শেরওয়ানি, জিন্স প্যান্ট ক্যান্ডি, বাহুবলী, বজরঙ্গি ভাইজান, আরমানি, ওয়েস্টার্ন, ডেসকট, বার্সেস ইত্যাদিই প্রধান। বছরের দুটি ঈদের মধ্যে কোরবানি ঈদে কোরবানির পশু কেনার জন্য একটি বড় খরচ রেখে দিতে হয় বিধায় তখন কাপড়-চোপড় ও পোশাক-পরিচ্ছদ কেনার জন্য কোনো বাজেট থাকে না। সে হিসেবে রমজানের ঈদই আসলে প্রকৃত অর্থে মানুষকে জুতা, পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়ে সাজানোর ঈদ আনন্দ উৎসব। এ ঈদ আনন্দ ভালোভাবে উপভোগ করার জন্য নিজের পরিবারে সবাই, জাকাত পরিশোধ, ফিতরা পরিশোধ, প্রতিবেশীর হক আদায়, আত্মীয়-স্বজনকে সন্তুষ্ট করার জন্য পোশাক, জুতা ইত্যাদি উপহার হিসেবে প্রদান করা হয়ে থাকে। এটি এখন দায়িত্বের পাশাপাশি একটি সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে।
এখন মুসলমানদের ঈদ এবং হিন্দুদের পূজা, খ্রিস্টানদের বড়দিনসহ অন্য ধর্মাবলম্বীদের আচারাদি সর্বজনীনতা পেয়েছে। সে জন্য ঈদে শুধু মুসলমানরাই নতুন পোশাক, জুতা কিনে পরে এমনটি নয়। এখন অন্য ধর্মাবলম্বীরাও ঈদে নিজেদের মতো করে এসব খাতে খরচ করে মুসলমানদের ঈদ উৎসব আনন্দে শামিল হতে দেখা যায়। ঈদ উপহারের এসব জিনিস আত্মীয়-স্বজনকে যেমন দেওয়া হয়, ঠিক তেমনি আবার উপহার হিসেবে নিজেদেরকেও অন্যরা দেয়। কাজেই এটি যেন ইংরেজি প্রবাদ, ‘গিভ অ্যান্ড টেক’ পদ্ধতিরই একটি অংশ। যা-ই হোক না কেন এগুলোই তো আসলে ঈদের প্রকৃত আনন্দ। দেশ-বিদেশে পর্যটনের মাধ্যমে ভ্রমণও থাকে সচ্চল অনেকের ঈদের বেড়ানোর তালিকায়। সঠিকভাবে বিচার করতে গেলে আমরা দেখতে পাব যে, ঈদের আনন্দ যে শুধু ঈদের একদিনই হয় এমনটি নয়। রমজান মাসের শুরুতেই সেই আনন্দ শুরু হয়ে যায়। কারণ রমজান মাস শুরু হলেই রোজা রাখার জন্য ইফতার ও সেহরি খাওয়া-দাওয়ার বিভিন্ন আইটেম কেনাবেচায়ও অনেক আর্থিক লেনদেন হয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হতে থাকে।
তারপর অর্ধ রমজানের পর থেকেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের ঈদ বোনাস দেওয়া শুরু করলেই ঈদের কেনাকাটা শুরু হয়ে যায়। বিপণিবিতানগুলো সারা রাত ধরে তাদের বিকিকিনি করতে থাকে। এসব ব্যবসা শুধু যে রাজধানী ঢাকাসহ বড় বড় শহরেই হয়ে থাকে এমনটি নয়। তা আসলে জেলা-উপজেলা ও অন্যান্য মফস্বলসহ সারা দেশের আনাচে-কানাচেই ছড়িয়ে পড়েছে এখন। বেনারসিপল্লী, পোশাক তৈরির কারখানায় সারা রাত ধরে কাজ চলে। তখন থেকেই নিজের বাড়িতে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য লঞ্চ, স্টিমার, বাস, ট্রেন, এয়ার ইত্যাদির টিকেট সংগ্রহের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ঈদের বিশেষ বিশেষ ট্রিপ মারার জন্য নতুন-পুরাতন যানবাহনকে রঙ-বেরঙে মেরামত করে সাজিয়ে তোলা হয়।
তা ছাড়া রসনাবিলাসী বাঙালির তো খাওয়াদাওয়ার প্রতি দুর্বলতা রয়েছেই। তারা শুধু নিজেরাই খায় তা নয়, আত্মীয়স্বজনকে দাওয়াত করে খাওয়ায়। সেসব প্রতিটি কাজেই আর্থিক সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। আর এসব আর্থিক সংশ্লিষ্টতা থেকেই হাজার হাজার কেটি টাকার পরিচালন ঘটে থাকে। দেশে যে যেখানেই থাকুক না কেন, শহরের শতকরা আশি ভাগ মানুষেরই গ্রামে তাদের রুট বা শিকড় রয়েছে। এবার নয়দিনের একটি লম্বা ছুটি দিয়েছে সরকার। খোদ রাজধানী ঢাকা থেকেই এবার প্রায় এক কোটি মানুষ গ্রামের বাড়িতে ঈদ করতে চলেছে। কাজেই এখন গ্রামীণ অর্থনীতিই সবচেয়ে বেঙি চাঙ্গা হয়েছে। অর্থাৎ অর্থকরী শহরে সৃষ্টি হয়ে শেষপর্যন্ত গ্রামকে রাঙাতে চলে এসেছে বলা চলে। ফলে হিসাব করে দেখা গেছে, এবারের (২০১৬) রমজানের ঈদে ৫০ থেকে ৬০ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয়ে দেশের সার্বিক অর্থনীতির চাকা সচল রয়েছে। সে জন্য ঈদে তখন সারা দেশের অর্থনীতি সচল থাকতে দেখা যায়। এভাবেই সকল দৈন্যতা, ভয় ও আতঙ্ককে পেছনে ফেলে সবার মধ্যে প্রকৃত ঈদের আনন্দ বহমান হোক-এটাই সবার প্রত্যাশা।
লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়