দেশের পর্যটনশিল্পকে টেকসই করতে লোকাল গাইডের ভূমিকা

বাংলাদেশে পর্যটনের সম্ভাবনা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। এ দেশের প্রকৃতি, সংস্কৃতি, ইতিহাস আর মানুষের জীবনযাত্রা মিলিয়ে এটি হতে পারত দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম আকর্ষণীয় গন্তব্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো আমরা সেই সম্ভাবনাকে এখনও পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারিনি। এখানে কেবল অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা কিংবা প্রচারের ঘাটতি নয় খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি জায়গায় আমরা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছি। সেটি হলো লোকাল গাইডের ভূমিকা।
একজন পর্যটক যখন অচেনা কোনো এলাকায় যান, তখন তার চোখে ধরা পড়ে দৃশ্যমান সৌন্দর্য, স্থাপনা কিংবা প্রকৃতি। কিন্তু সেই জায়গার আসল গল্প, ইতিহাস, মানুষের জীবন, সংস্কৃতির বহতা ধারা- এসব তাকে জানানোর দায়িত্ব থাকে একজন স্থানীয় গাইডের ওপর। তাই বলা যায়, লোকাল গাইড শুধু তথ্য জানানোর মানুষ নন; তিনি এক অর্থে পুরো এলাকার প্রতিনিধি।
পর্যটকের অভিজ্ঞতা নির্ধারণ করে গাইড
ধরা যাক, বিদেশ থেকে কেউ এসেছে সোনারগাঁ, পাহাড়পুর বা সুন্দরবন দেখতে। তার জন্য ট্রান্সপোর্ট, হোটেল, খাবার- এসব অবশ্যই জরুরি। কিন্তু গন্তব্যে পৌঁছে তিনি যদি একজন দক্ষ লোকাল গাইড পান, তাহলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা হয়ে উঠতে পারে বহুগুণ সমৃদ্ধ। কারণ সেই গাইড জানবেন, কোন পথ ধরে হাঁটলে প্রকৃতির আসল সৌন্দর্য ধরা দেবে, কোন গল্প বললে পর্যটক সত্যিই আবেগ ছুঁয়ে যাবেন। এক্ষেত্রে গাইড কেবল দিকনির্দেশক নয়, বরং একজন গল্পকার, সংস্কৃতির দূত এবং কখনো কখনো স্থানীয় অর্থনীতির প্রবক্তা।
অন্যদিকে, গাইড যদি অদক্ষ হন, পর্যটকের মন খারাপ হয়ে যায়। ভুল তথ্য দেন, পর্যটকের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেন না, অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেন বা কোনোভাবে হয়রানি করেন, তাহলেই বাংলাদেশের ইমেজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে একজন পর্যটকের অভিজ্ঞতা পুরো শিল্পের ভাবমূর্তি নির্ধারণ করতে পারে।
অর্থনীতির চাকা সচল রাখে লোকাল গাইড
বাংলাদেশের পর্যটনশিল্প এখনও মূলত স্থানীয় পর্যটকের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু ধীরে ধীরে বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের অনেকেই স্থানীয় গাইড ছাড়া চলতে পারেন না। একজন দক্ষ গাইডের কারণে একজন পর্যটক অতিরিক্ত সময় কোনো এলাকায় থাকতে আগ্রহী হন। এতে হোটেল, রেস্টুরেন্ট, দোকানপাট- সবখানেই অর্থের প্রবাহ বাড়ে।
সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, গাইডরা সাধারণত এলাকারই মানুষ। তাই পর্যটকের খরচ থেকে সরাসরি উপকৃত হন স্থানীয়রা। এক অর্থে, লোকাল গাইডরা গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল রাখার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
ইতিহাস ও সংস্কৃতির সেতুবন্ধন
লোকাল গাইড মানে শুধু জায়গা দেখানো নয়; বরং ইতিহাস, সংস্কৃতি আর জীবনধারার সেতুবন্ধন তৈরি করা। উদাহরণস্বরূপ, কক্সবাজারে একজন গাইড যদি পর্যটককে শুধু সমুদ্র সৈকত দেখিয়ে ছেড়ে দেন, তবে অভিজ্ঞতা হয় সামান্য। কিন্তু যদি তিনি আরাকানি রোহিঙ্গা খাবারের গল্প বলেন, স্থানীয় জেলেদের জীবন দেখান, সমুদ্রের জোয়ার-ভাটার বিজ্ঞান ব্যাখ্যা করেন, তাহলে পর্যটক এ দেশের প্রকৃত জীবন বুঝতে পারবেন।
এভাবেই লোকাল গাইডরা অচেনা সংস্কৃতি আর বিদেশি পর্যটকের মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করেন। এ কাজটি করতে গিয়ে তারা একধরনের সাংস্কৃতিক দূত হয়ে ওঠেন।
সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে লোকাল গাইডিং এখনো একটি সংগঠিত পেশা হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে তাদের সামনে নানান সমস্যা থাকে। বাংলাদেশের লোকাল গাইডদের উল্লেখযোগ্য কিছু সমস্যা-
প্রশিক্ষণের অভাব
অধিকাংশ গাইডের কোনো আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। ফলে তারা সঠিক তথ্য দিতে পারেন না।
ভাষাগত সীমাবদ্ধতা
ইংরেজি বা অন্যান্য বিদেশি ভাষায় দক্ষ গাইডের সংখ্যা খুবই কম।
প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি নেই
গাইড হিসেবে কোনো পেশাগত পরিচয় বা লাইসেন্স নেই। ফলে প্রতারণার সুযোগ তৈরি হয়।
অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা
মৌসুমি পর্যটনের কারণে সারা বছর আয় থাকে না, গাইডরা অস্থির জীবনে ভুগেন।
করণীয়
বাংলাদেশ পর্যটন বোর্ড কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে একটি পূর্ণাঙ্গ গাইড প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। এখানে ইতিহাস, ভূগোল, সংস্কৃতি, যোগাযোগ দক্ষতা, ভাষা ও আচরণবিধি নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে। গাইডদের জন্য লাইসেন্স প্রথা চালু করা দরকার, যাতে ভুয়া গাইডরা বাদ পড়ে যায়।
একইসাথে, পর্যটন শিল্পে গাইডদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। গাইডকে কেবল সঙ্গী বা ভাড়া করা মানুষ হিসেবে না দেখে, তাদেরকে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে ভাবা প্রয়োজন।
এক কথায় বাংলাদেশের পর্যটনশিল্পকে টেকসই করতে চাইলে লোকাল গাইডদের শক্ত অবস্থান তৈরি করা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। তারা কেবল পর্যটকের পথপ্রদর্শক নন, বরং এ দেশের সৌন্দর্য, সংস্কৃতি আর ইতিহাসের জীবন্ত মুখপাত্র। তাই সরকার, বেসরকারি খাত আর স্থানীয় জনগোষ্ঠী—সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় লোকাল গাইডদের দক্ষতা বাড়ানো এবং পেশাটিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠা করা এখন সময়ের দাবি।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী