পৌনে পাঁচ কোটি তরুণের দেশ—বাংলাদেশ কি পারবে এই সুবর্ণ সুযোগ কাজে লাগাতে?

১২ আগস্ট আন্তর্জাতিক যুব দিবস। বর্তমান বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড। যখন কোনো দেশের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী কর্মক্ষম বয়সে থাকে, তখন সেটিকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৬৮ শতাংশই কর্মক্ষম বয়সে। জাপান, চীন, মালয়েশিয়া এবং লাতিন আমেরিকার বেশ কিছু দেশ গত কয়েক দশকে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। আমাদের দেশেও প্রায় পৌনে পাঁচ কোটি তরুণের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে, যা বিশাল সম্ভাবনার ইঙ্গিত দেয়।
জাতিসংঘের জনসংখ্যা তহবিলের সংজ্ঞা অনুযায়ী, যখন কর্মক্ষম মানুষের সংখ্যা কর্মক্ষমহীন মানুষের তুলনায় বেশি হয় এবং সেই কাঠামোগত পরিবর্তন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে, তখনই তাকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হয়। সহজভাবে বললে, এটি এমন এক সময়কাল, যখন কর্মক্ষম বয়সের মানুষ (১৫-৬৪ বছর) নির্ভরশীল জনগোষ্ঠীকে (০-১৪ বছর ও ৬৫ ঊর্ধ্বে) ছাড়িয়ে যায়। এই সময়কে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগকাল হিসেবে ধরা হয়।
গবেষণা বলছে, বাংলাদেশ ২০০৭ সাল থেকে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডে প্রবেশ করেছে। কিছু প্রতিবেদনে আবার উল্লেখ রয়েছে, ২০১২ সাল থেকেই আমরা এই অবস্থায় রয়েছি। সাধারণত একটি দেশ এই পর্যায়ে থাকে ৩০ থেকে ৩৫ বছর। সে হিসেবে ২০৪০ সাল পর্যন্ত এই সুযোগ আমাদের হাতে থাকবে। প্রশ্ন হলো—আমরা কি এই সুবিধাকে কাজে লাগাতে পেরেছি? বাস্তবতা হলো, রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য দেখাতে পারেনি। আর ভবিষ্যতে তা সম্ভব হবে কি না, তা নির্ভর করছে সরকারের সময়োপযোগী নীতি, কার্যকর পরিকল্পনা এবং সেগুলোর সফল বাস্তবায়নের ওপর।
এই সুযোগ কাজে লাগানোর জন্য এখনই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে, কারণ হাতে রয়েছে সর্বোচ্চ ১৫ বছর। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে সর্বোচ্চ বিনিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ করে শিক্ষাব্যবস্থাকে করতে হবে কর্মমুখী ও প্রযুক্তিনির্ভর। আমাদের দেশের বহু প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পর্যায়ের পদে বিদেশি নিয়োগ দিতে হয়—এর প্রধান কারণ স্থানীয় পর্যায়ে দক্ষ জনশক্তির অভাব। তাই সেক্টরভিত্তিক টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ সম্প্রসারণ জরুরি। বিদেশে কর্মসংস্থানের জন্য দূতাবাসগুলো আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারের চাহিদা নির্ধারণ করে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিতে পারে, আর দেশের ভেতরে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির জন্য একটি জাতীয় মাস্টারপ্ল্যান গ্রহণ করতে হবে।
আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। স্কুল পর্যায় থেকেই হাতে-কলমে শিক্ষা ও কারিগরি প্রশিক্ষণ চালু করতে হবে। সবাই ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবে—এমন ধারণা থেকে বেরিয়ে এসে শিশুদের বহুমুখী পেশার জন্য প্রস্তুত করা জরুরি। প্রথম শ্রেণি থেকেই কারিগরি শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরিতে জোর দিতে হবে। এতে শিক্ষিত কিন্তু বেকার মানুষের সংখ্যা কমবে এবং উৎপাদনশীল জনশক্তি বাড়বে।
ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের পূর্ণ সুফল পেতে হলে টেকসই নীতি প্রণয়ন ও কার্যকর বাস্তবায়ন অত্যাবশ্যক। ভূমি, পুঁজি, কৃষি ও শিল্পে উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, মানবসম্পদ উন্নয়ন এবং বেকারত্ব নিরসনে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। একইসঙ্গে ২০৪৭ সালে যখন বাংলাদেশ একটি প্রবীণ রাষ্ট্রে রূপ নেবে, সেই সময়ের জন্যও এখন থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি।
বিদেশে অবস্থানরত দক্ষ বাংলাদেশীদের অভিজ্ঞতা ও নেটওয়ার্ককে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগাতে হবে। প্রবাসীদের বিনিয়োগ, উদ্যোক্তা কার্যক্রম ও জ্ঞান বিনিময়কে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলে প্রযুক্তি স্থানান্তর ও শিল্পোন্নয়নে গতি আসবে।
মোট জনসংখ্যার মধ্যে তরুণদের এই বিপুল অংশ বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল সম্ভাবনার ক্ষেত্র। যদি তাদের সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও কর্মশক্তি সঠিকভাবে কাজে লাগানো যায়, তবে এই দেশকে অর্থনৈতিকভাবে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত পরিবেশ, সমান সুযোগ ও সঠিক দিকনির্দেশনা। সময় এখনই—ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের জানালা চিরকাল খোলা থাকবে না। এখন পদক্ষেপ না নিলে এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে।
লেখক : মহাসচিব, ইয়ুথ হাব ফাউন্ডেশন মালয়েশিয়া