মেডিটেশনে ভ্যাট কেন?

অসুখ মানে কাব্য করে যদিও ‘সুখের অভাব’ বলে, তবু আমরা সাধারণত শারীরিক অস্বস্তি অর্থেই অসুখকে বুঝি। আর মানসিকভাবে কেউ যদি নিজেকে সুস্থ ভাবতে শুরু করে, তবে শারীরিক অসুখেরও শতকরা ৭৫ ভাগ এমনিতেই ভালো হয়ে যায়! মেডিটেশন হচ্ছে সেই মনের চিকিৎসা। নীরবে বসে সুনির্দিষ্ট অনুশীলন যে শুধু শারীরিক যন্ত্রণা থেকেই মুক্তি দেয় তা নয়, বরং এর ফলে মনে প্রশান্তি আসে ও যে কোনো কাজে একাগ্রতা তৈরি হয়। সাধনা আর আধুনিক বিজ্ঞানের সমন্বয়ই এই মেডিটেশন তথা ধ্যান, যোগ বা প্রাণায়াম।
জেনে অবাক হয়েছি যে বিশ্বব্যাপী মেডিটেশন জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে যখন অনুদানসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে, তখন বাংলাদেশে মেডিটেশনের ওপর ভ্যাট তথা মূল্য সংযোজন কর (মূসক) আরোপ করা হচ্ছে!
মেডিটেশন কোনো ভোগ্যপণ্য নয়। এটি একটি পরিপূরক চিকিৎসাসেবা। যেহেতু আমাদের দেশে চিকিৎসাসেবার ওপর কোনো ভ্যাট নেই, তাই মেডিটেশন-সেবার ওপর পুনরায় ভ্যাট আরোপ করা হলে এ সেবা গ্রহণে সর্বস্তরের মানুষ নিরুৎসাহিত হতে পারে এবং সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা-ব্যয় কমিয়ে শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিকভাবে জাতি হিসেবে আমরা যে লাভবান হতে পারতাম তা থেকে বঞ্চিত হব। অন্যদিকে মেডিটেশন-সেবাকে ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হলে দেশের অধিক সংখ্যক মানুষ এ সেবা গ্রহণ করতে সক্ষম হবেন।
অনিদ্রা, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, আমাশয়, পেটের পীড়া, আলসার ও চর্মরোগসহ ধূমপান, অ্যালকোহল বা যে কোনো মাদক ইত্যাদির নেশা পরিত্যাগ, ফুসফুসের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি, ক্রনিক ঠান্ডা, অ্যাজমা, ব্রংকাইটিস, মাইগ্রেন, পিঠব্যথা ও বাতব্যথা নিরাময়ে মেডিটেশন দারুণ কার্যকর।
নাগরিক জীবনে যেখানে সবকিছুতেই অস্বস্তি, সেখানে মেডিটেশন শান্তি এনে দিতে পারে অনেকটাই। এ সময়ে দিনের পর দিন লোকচক্ষুর আড়ালে গিয়ে ধ্যান করা হয়তো সম্ভব না হতে পারে, কিন্তু দিনের কিছুটা সময় হোক মাত্র ১৫ মিনিট মেডিটেশন করতে পারলে বিক্ষুব্ধ মন শান্ত হবে অনেকটাই। শুধু তাই নয়, মেডিটেশন আমাদের ক্লান্তি-অবসাদ এবং খেয়ালি মনের বিরুদ্ধে লড়তেও সাহায্য করে।
মেডিটেশন করতে চাইলে প্রথমে মন ঠিক করতে হবে। এটা খুব সহজ ও সাধারণ বিষয়, এর জন্য বাড়তি কোনো আড়ম্বরেরও প্রয়োজন নেই। মেডিটেশনের ওপর বই, সিডি ইত্যাদি বাজারে পাওয়া যায়। এগুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে নিলেই সঠিক নিয়মে মেডিটেশন করা সম্ভব। এ ছাড়া আমাদের দেশে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে, যারা মেডিটেশন কোর্স করায়। চাইলে তাঁদের কাছ থেকেও সাহায্য নেওয়া যায়।
যোগ-মেডিটেশনের বহুমুখী মনোদৈহিক উপকারিতা বিবেচনা করে ২০১৫ সালে জাতিসংঘের ৬৯তম সাধারণ অধিবেশনে ১৭৫টি দেশের সমর্থনে ২১ জুনকে ‘বিশ্ব যোগ দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়। প্রথমবারের মতো এই বিশ্ব যোগ দিবস উদযাপনে সবার সঙ্গে যোগ-মেডিটেশনে অংশ নেন জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন নিজেও।
এর ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্রে চিকিৎসা ব্যয় সংকোচনের উদ্দেশ্যে মানুষকে মেডিটেশন করানো হচ্ছে, ভারতে ২০১৫-১৬ সালের বাজেটে যোগ-মেডিটেশনের ওপর আরোপিত সার্ভিস ট্যাক্স স্থায়ীভাবে প্রত্যাহার করা হয়েছে এবং যুক্তরাজ্যে দেশব্যাপী মেডিটেশন প্রশিক্ষণের জন্য ১০ মিলিয়ন পাউন্ড বরাদ্দের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ রক্তচাপ চিকিৎসা নীতিমালায়ও বলা হয়েছে, চিকিৎসকরা যেন স্ট্রেস-আক্রান্ত ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীদের নিয়মিত যোগ, মেডিটেশন, শিথিলায়ন ও দমচর্চা ইত্যাদির পরামর্শ দেন।
এর আগেও ২০১৪-১৫ সালের বাজেটেও মেডিটেশনের ওপর ভ্যাট প্রস্তাব করা হয়েছিল। পরে, সুস্থ জাতি ও সমৃদ্ধ দেশ গঠনে মেডিটেশনের গুরুত্ব অনুধাবন করে অর্থমন্ত্রী তা প্রত্যাহার করেছিলেন। কিন্তু ২০১৬-১৭ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ধ্যানে (মেডিটেশন) কর আরোপ করায় সমালোচনার ঝড় চলছে বিভিন্ন মহলে। ধ্যানে কর আরোপের প্রস্তাব বিস্ময়কর বলে মনে করছেন তাঁরা। হঠাৎ করে নতুন বাজেটে মেডিটেশন-সেবায় করারোপের প্রস্তাবে সামাজিক মাধ্যমসহ চারদিকে সমালোচনার ঝড় উঠেছে।
অর্থমন্ত্রী একজন প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ ব্যক্তি, আমি নিশ্চিত তাঁকে যদি জানানো যায় যে মেডিটেশন-সেবা ভ্যাটের আওতামুক্ত রাখা হলে একজন মানুষের চিকিৎসা ব্যয় অনেকাংশেই সাশ্রয় হবে – যা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিতেও অত্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে।
মেডিটেশনে ভ্যাট আরোপ না হলে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে আপাতত যে কয়েক লাখ টাকা জমা হবে না, তার চেয়ে শতগুণ বেশি রাজস্বসমৃদ্ধ করতে পারবে মেডিটেশন চর্চা করে উপকৃত সুস্থ প্রশান্ত শৃঙ্খলাপ্রিয় প্রত্যয়ী ধ্যানী জনশক্তি।
লেখক : একটি প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানের বিপণন ব্যবস্থাপক