সাংবাদিকতা
দস্যু বাহিনীর আত্মসমর্পণ, সুন্দরবনে ৭৭ বার

গত ৩১ মে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় দস্যু বাহিনী অস্ত্র-গুলিসহ আত্মসমর্পণ করেছে। এ দেশের ইতিহাসে যা প্রথম। এই পুরো প্রক্রিয়াটির মধ্যস্থতার দায়িত্ব ছিল আমার ঘাড়ে। একজন সাংবাদিক হিসেবে এই দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি শেষ পর্যন্ত। অবশ্য এ জন্য সময়ও দিতে হয়েছে ছয়-ছয়টি বছর। সুন্দরবনে গিয়েছি অন্তত ৭৭ বার। ঝুঁকিও কম ছিল না সেই কাজে! তবে শেষ পর্যন্ত কাজটি করতে পেরেছি আমরা। মাস্টার বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবরে আন্দোলিত হয়েছে সুন্দরবন ও সংলগ্ন সাগরের ওপর নির্ভরশীল লাখো মানুষ। যে মানুষের জন্য আমি কাজ করতে শুরু করি ২০০৯ সাল থেকে।
জলদস্যুদের হাতে জিম্মি সুন্দরবন উপকূলের গরিব জেলে-বাওয়ালিরা। দস্যু দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার পাশাপাশি অন্য কিছু একটা করার তাগিদ ছিল শুরু থেকেই। কারণ, গহিন সুন্দরবনে অভিযান চালিয়ে বনদস্যুদের জব্দ করা মোটেই সহজ কাজ না। দিনের পর দিন সুন্দরবনের গভীরে অবস্থানের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, এটি বেশ কঠিন কাজ। প্রায় অসম্ভব। তাই দস্যু দমনে র্যাব-পুলিশ-কোস্টগার্ডের তৎপরতার পাশাপাশি এই উদ্যোগ যে কার্যকর, তা শেষ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠিত হলো।
জলোচ্ছ্বাস আইলার পর সাতক্ষীরার সুন্দরবনসংলগ্ন লোকালয়ে কাজ করতে গিয়ে জানলাম বনদস্যুদের ভয়াবহ নির্যাতনের কথা। সেই জনপদ তখনো জলোচ্ছ্বাসে ছিন্নভিন্ন। তারপরও সবকিছু ছাপিয়ে উপকূলের মানুষের দুশ্চিন্তা বনদস্যুদের নিয়েই। কারণ, আইলার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দ্রুত তাদের নামতে হবে সুন্দরবনে। যেতে হবে মাছ-কাঁকড়া ধরতে। কিন্তু মান্নান বাহিনী কিংবা মোতালেব বাহিনীর মতো দস্যুদের ভয়ে তারা বনে যেতে পারছিলেন না। সবারই জানা, এবার ধরা পড়লে মুক্তিপণ দেওয়ার মতো টাকা তাদের কারো হাতেই নেই। আমার নিজের এ বিষয়ে ভাবনার শুরু সেখান থেকেই। এই মানুষগুলোর জন্য কিছু একটা করতে চাই আমি। কিন্তু কী করব? তখনো পরিষ্কার নয়।
২০১০ সালের কথা। তখন কাজ করি এটিএন নিউজে। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রয়াত মিশুক মুনীরের কাছে সুন্দরবন নিয়ে আগ্রহের কথাটি জানাই। প্রিয় মিশুক স্যার বললেন, ‘এগিয়ে যাও।’
শুরুতে শুধুই হোঁচট খাচ্ছিলাম। কারণ, সঠিক কোনো তথ্য কারো কাছেই নাই। ভাসা ভাসা ধারণা নিয়ে কাজ শুরু করি। সে সময়ের সবচেয়ে বড় দস্যু রাজু বাহিনীর প্রধান রাজুর সঙ্গে কথা হয়। মংলার সাংবাদিক নিজাম উদ্দীনকে সঙ্গে নিয়ে একদিন চলে যাই রাজুর আস্তানায়। সেখানেই পরিচয় মোস্তফা শেখের (সদ্য বিলুপ্ত মাস্টার বাহিনীর প্রধান) সঙ্গে।
২০১৩ সালে মোস্তফা শেখ বাড়ি ফিরে আসেন। নতুন মাছের ঘের, তার ভেতরে ছোট্ট একটি অসমাপ্ত গোলপাতার ঘর। স্ত্রী-কন্যা নিয়ে নতুন করে বেঁচে থাকার চেষ্টা। সেই বাড়ির বারান্দায় একটি রাতও কাটিয়েছি। মোস্তফা বলেছিলেন, আর কখনোই দস্যুতার পথে পা বাড়াবেন না।
তিন মাস পর হঠাৎ ফোন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের লোকজন মোস্তফার ছোট ভাইকে হত্যা করেছে। প্রাণভয়ে তিনি আবারও পালিয়ে যান সুন্দরবনে। আবারও নতুন করে বাহিনী গঠন করে দস্যুতা চালাতে থাকেন। কয়েক দিনের মধ্যেই মাস্টার বাহিনীর নাম ছড়িয়ে পড়ে। তবে মাস্টার বাহিনীর প্রধান মোস্তফা শেখ বারবার আমাকে বলেছেন, অভিশাপের এই জীবন থেকে মুক্তি চান। এমনকি ভারতে পালিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতিও নিচ্ছিলেন। আমি বাদ সাধলাম। বললাম, একটু অপেক্ষা করতে। তিনি রাজি হলেন। বললেন, ‘যদি আত্মসমর্পণ করার সুযোগ আসে, তবে জেল খাটতেও রাজি।’
প্রায় আড়াই বছর তাদের সঙ্গে কথা চলছিল। সামনাসামনি দেখাও করি কয়েকবার। নিয়ম ভেঙেছি শুধু একটি বিষয়েই। সবার চোখ এড়িয়ে সুন্দরবনে প্রবেশ করেছি, থেকেছি দিনের পর দিন। কখনো যমুনা টেলিভিশনের টিম নিয়ে, কখনো একাই ছুটে গেছি সেখানে। দস্যুদের সঙ্গে সঙ্গে থেকে তাদের বুঝিয়েছি দিনের পর দিন। এর মধ্যে জীবনের ঝুঁকিও নিতে হয়েছে। একবার তো কোস্টগার্ডের গুলির মুখেও পড়তে হয়েছে। তবে সাংবাদিকতার নীতি থেকে একচুলও সরিনি।
একটা সময় মাস্টার বাহিনীর সদস্যরা আশ্বস্ত হন। বাহিনীপ্রধান মোস্তফা শেখ আত্মসমর্পণের পুরো দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দেন। কাজটি তখন থেকে আরো কঠিন হয়ে গেল। কারণ, সরকারের পক্ষ থেকে সবুজসংকেত না পেলে তো কিছুই হবে না। মংলার সাংবাদিক নিজাম উদ্দীনকে সঙ্গে নিয়ে কাজ এগিয়ে নিতে থাকি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েকটি সংস্থার সঙ্গেও কথা বলি। এগিয়ে আসে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন। প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালকের নির্দেশে র্যাব-৮-এর পক্ষ থেকে আগ্রহ জানানো হয়। পুরো বিষয়টি জানার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালও সম্মতি জানান। তার পর থেকেই কঠিন কাজগুলো সব সহজ হতে থাকে।
মাসখানেক সময় নিয়ে আত্মসমর্পণ করে সুন্দরবনের ত্রাস মাস্টার বাহিনী। ২৮ মে সন্ধ্যার আগেই তাদের সব অস্ত্র ও গুলি তুলে দেয় আমার হাতে। ৫১টি আগ্নেয়াস্ত্র, প্রায় পাঁচ হাজার রাউন্ড গুলি ও তাদের ব্যবহারের সিক্স সিলিন্ডারের ট্রলারটি নিয়ে গভীর রাতে চলে আসি চরাপুটিয়ার ভারানিতে। সেখানে অপেক্ষমাণ র্যাব-৮-এর উপ-অধিনায়ক মেজর আদনান কবীর। সে রাতেই তাঁর হাতে তুলে দিই দস্যুদের। বলতেই হয়, মেজর আদনানের ওপরও ভরসা ছিল দস্যুদের। কারণ, এ নিয়ে তিনিও একই সঙ্গে কাজ করছিলেন, তাঁর মতো করে।
আত্মসমর্পণের পুরো কাজটি করেছি একজন সাংবাদিক হিসেবে, সঙ্গে স্থানীয় সাংবাদিক নিজাম উদ্দীন কাজ করেছেন দিন-রাত এক করে। সহযোগিতা করেছেন আরো অনেকে। কাজটি করতে গিয়ে নানা রকমের চ্যালেঞ্জ এসেছে সামনে। কিন্তু দমে যাইনি আমরা। কারণ, সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। সুন্দরবনের দস্যুতা দমনে সহযোগী হিসেবে এই কাজ করার সুযোগ হাতছাড়া করা বড় বেশি বোকামি হয়ে যেত। কারণ, এদের হাতেই জিম্মি লাখ লাখ হতভাগ্য গরিব মানুষ। সাংবাদিক হিসেবে তো বটেই, মানুষ হিসেবেও এখানে দেশ-মানুষের জন্য কিছু করে দেখানোর সুযোগ ছিল। সে সুযোগ হাতছাড়া করিনি। কৃতজ্ঞতা যমুনা টেলিভিশন কর্তৃপক্ষকে। কারণ, স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তাঁরা আমাকে দিয়েছেন।
সুন্দরবনের ভেতর থেকে কুখ্যাত ১০ দস্যুকে ফিরিয়ে আনতে পেরেছি লোকালয়ে। যেসব অবৈধ অস্ত্র ব্যবহৃত হতো সাধারণ জেলেদের বিরুদ্ধে, তার একটি বড় অংশ সুন্দরবন থেকে বের করে আনতে পেরেছি। এটাই আমার এ উদ্যোগের সার্থকতা। এতে করে উৎসাহী হয়েছে অন্যরাও। আরো অন্তত চারটি বাহিনী একই পথে স্বাভাবিক জীবনে আসতে চায়। এরই মধ্যে তারাও যোগাযোগ শুরু করেছে।
যাই হোক, গত ৩১ মে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করে সুন্দরবনের দস্যু মাস্টার বাহিনী। এর পর থেকেই উপকূলের মানুষের শুভকামনা পাচ্ছি। এড়িয়ে চলছি সংবর্ধনার মতো আনুষ্ঠানিকতা। ভালো লাগা তো আছেই। তবে একই সঙ্গে ভাবছি, আমাদের সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বশীলতার কথা। কারণ, এ দেশের একটি সংবাদমাধ্যমও এ বিষয়ে সঠিক সংবাদ প্রচার বা প্রকাশ করেনি। তার পরও বলছি, মানুষ হিসেবে, সাংবাদিক হিসেবে আমি আমার কাজ চালিয়ে যাব। কারণ, উপকূলের খেটে খাওয়া গরিব মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার লোভ সামলানো আমার জন্য বেশ কঠিন।
লেখক : বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন।