বাজেট ভাবনা
এই অর্থনৈতিক পরিকল্পনা কি জনগণের জন্য?

অর্থমন্ত্রী গত বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সরকারের অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি অষ্টমবারের মতো বাজেট পেশ করলেন। এর আগে তিনি সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের আমলেও দুবার বাজেট দিয়েছিলেন যথাক্রমে ১৯৮২-৮৩ ও ১৯৮৩-৮৪ সালে। নিঃসন্দেহে তিনি একজন অভিজ্ঞ অর্থমন্ত্রী এবং আমলাও বটে। তবে এবারের বাজেট (২০১৬-১৭ সালের) যতদূর জানলাম, দেখলাম, পড়লাম ও অনুধাবন করলাম তাতে আমার কাছে এ বাজেটকেও অনেকটাই গতানুগতিক বাজেট বলে মনে হয়েছে। বাজেটের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে খুব সহজেই এটা বোধগম্য হবে।
প্রথমত : বাজেটের আকার গত বছরের তুলনায় সামান্যই বেড়েছে। গত বছর ছিল ২ লাখ ৮৩ হাজার ৬৭৯ কোটি (প্রকৃত) যা এবার হয়েছে ৩ লাখ ৪০ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা।
দ্বিতীয়ত : বরাবরের মতো এবারও অনুন্নয়ন ব্যয়ের আধিক্য বিদ্যমান। ২০১৫-১৬-এর বাজেটে উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন বাজেটের অনুপাত ছিল ৩৫:৬৫ অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকার মধ্যে উন্নয়ন ব্যয় ছিল মাত্র ৩৫ টাকা আর অনুন্নয়ন ব্যয় ৬৫ টাকা। প্রস্তাবিত ২০১৬-১৭ সালের বাজেটে এ অনুপাতটার আরো অবনতি হয়েছে, অর্থাৎ উন্নয়ন ব্যয়ের অংশ হ্রাস পেয়ে হয়েছে মাত্র ৩২.৫% এবং অনুন্নয়ন ব্যয়ের অংশ বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬৭.৫% (৩২.৫:৬৭.৫)। অথচ হওয়া উচিত ছিল ঠিক উল্টোটা, অর্থাৎ ৬৭.৫:৩২.৫। এটা মোটেও সুস্থ অর্থনীতির পরিচায়ক নয়। আমরা বুঝতে অক্ষম মাথাভারী প্রশাসন পুষতেই যদি রাজস্ব আয়ের সিংহভাগ ব্যয় হয়ে যায়, তাহলে উন্নয়ন হবে কীভাবে।
তৃতীয়ত : বরাবরের মতোই করের বোঝাটা সাধারণ মানুষের ওপরেই চাপানো হয়েছে। অর্থাৎ পরোক্ষ কর থেকেই রাজস্ব আয়ের সিংহভাগ আসবে বলে আশা করা হয়েছে। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ করের অনুপাত যেখানে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটে ৩৪:৬৬ ছিল, প্রস্তাবিত বাজেটে তা প্রায় অপরিবর্তিতই রয়েছে : ৩৫.৪:৬৪.৬। লক্ষণীয় যে, রাজস্ব আয়ের জন্য সরকার প্রায় পুরোপুরি জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ওপর নির্ভরশীল। প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব বোর্ড ও রাজস্ব বোর্ডবহির্ভূত প্রাপ্তির অনুপাতটা হচ্ছে : ৮৩.৭:১৬.৩। রাজস্ব বোর্ড তার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মূসক ও শুল্কসহ অন্যান্য পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল (মূসক থেকে ৩৫.৮% এবং শুল্কসহ অন্যান্য থেকে ২৮.৮, অর্থাৎ ৩৫.৮+২৮.৮ = ৬৪.৬%)।
চতুর্থত : বরাবরের মতোই প্রস্তাবিত বাজেটও বিদেশি সাহায্য নির্ভরশীল বাজেট। বাজেটে সার্বিক ঘাটতি হচ্ছে ৯৭ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা, যার মধ্যে বিদেশি উৎস থেকে আসবে ৩৭.১% এবং বাকিটা অর্থাৎ ৬২.৯% আসবে অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে (ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৩৯.৮% এবং ২৩.১% সঞ্চয়পত্রসহ অব্যাংক উৎস থেকে)
পঞ্চমত : এবার বরাদ্দের অগ্রাধিকারে অর্থমন্ত্রী শিক্ষাকে এক নম্বরে দেখালেও মহাজোট সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার অর্থাৎ শিক্ষকদের জন্য পৃথক ও উচ্চতর স্কেল তথা আলাদা বেতন কাঠামোর ব্যাপারে একেবারেই নীরবতা পালন করেছেন। শিক্ষা খাতে সর্বোচ্চ বরাদ্দের ক্ষেত্রে তিনি অত্যন্ত চাতুর্যতার সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও কারিগরি, উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়গুলোকে একত্রিত করে বরাদ্দ সর্বোচ্চ দেখিয়েছেন। ২০১০ এর শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে যে পরিমাণ বরাদ্দ প্রয়োজন তা দেওয়া হয়নি বলে আমার মনে হচ্ছে।
ষষ্ঠত : একই অবস্থা যোগাযোগ ও অবকাঠামোতেও। এখানেও কয়েকটি খাতকে একত্রিত করে বরাদ্দ বেশির কথা প্রচার করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে রেল পরিবহন ও নৌপরিবহনকে অনেকটাই অবহেলা করা হয়েছে বলে আমার মনে হচ্ছে।
সপ্তমত : অর্থমন্ত্রী মহোদয় মেগা প্রকল্পের নামে পৃথক বরাদ্দের প্রস্তাব রেখেছেন ১৮ হাজার ৭২৭ কোটি টাকার (পদ্মা সেতু : ৬,০২৬.৪৮; বাকিটা মেট্রোরেল, দোহাজারী-কক্সবাজার-ঘুনধুম রেল লাইন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য প্রকল্পের জন্য)। এটা ভালো প্রস্তাব, তবে মেগা প্রকল্প থেকে সুফল পেতে হলে যে ধরনের পরিবহন অবকাঠামো প্রয়োজন রেল-নৌ-বিমান সুসমন্বিত, সে সম্পর্কে তিনি কিছুই বলেননি।
অষ্টমত : প্রশাসনিক তথা আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি, দুর্বলতা, রাজনীতির দুর্বলতা-দুর্নীতি নিয়ে কোনো কথাই বলেননি অর্থমন্ত্রী। বরং দেখা গেছে দুর্বৃত্ত-লুটেরা, রেন্ট-সিকারদের চাপে বরাবরের মতোই কালো টাকা সাদা করার সুযোগ বহাল রেখেছেন বা রাখতে যাচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে আমার ব্রিটিশ সাহিত্যিক, মনীষী, দার্শনিক শেকসপিয়রের একটি মন্তব্য মনে পড়ছে। তিনি মধ্যযুগীয় ব্রিটিশ সমাজের রাজতন্ত্রের দুর্নীতি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘দেশের রাজা যদি অন্যায়ভাবে ডিম অমলেট খায়, তবে তার প্রজারা অন্যায়ভাবে মুরগি রোস্ট খাবে।” শেকসপিয়রের কথা আমাদের অর্থমন্ত্রীও প্রমাণ করলেন আরেকবার। কালো টাকা সাদা করার নীতি বহাল রেখে তিনি অন্যায়-অন্যায্যতাকেই পক্ষান্তরে উৎসাহিত করলেন। দেশের শাসক শ্রেণি তথা পুঁজিপতি শ্রেণি যদি এহেন কাজ করেন তাহলে অন্যান্য শ্রেণি-পেশার মানুষকে দোষ দিয়ে কাজ হবে কি? তারা আজান দিয়ে অন্যায়-অন্যায্য কাজে লিপ্ত হবে বটে। কে বাধা দেবে তাদের? নদী-খাল-জলাশয়সহ সরকারি খাসজমি ও সম্পত্তি দখল-জবরদখল কি তারই নমুনা নয়?
সবশেষে যে কথাটি বলা প্রয়োজন বলে মনে করছি তা হলো এই যে, করের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে সমাজে বৈষম্য হ্রাসসহ আর্থসামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করা। পাকিস্তানি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলাম বৈষম্য থেকে মুক্তির লক্ষ্যে। দেশকে স্বাধীন করেছিলাম বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। আমাদের সংবিধানে চারটি মৌলিক নীতি (বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র) বিধিবদ্ধ হয়েছিল বৈষম্যমুক্ত অসাম্প্রদায়ক, উদার, গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, আমাদের দেশে যাঁরা পরিকল্পনা ও বাজেট রচনার সঙ্গে জড়িত থাকেন, তাঁরা সংবিধানের এ মৌলিক স্তম্ভগুলো হয় আদৌ স্মরণ করেন না অথবা গোষ্ঠীস্বার্থে ভুলে থাকেন। এ ক্ষেত্রে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল আমাদের দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৭৩-৭৮) এবং তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ কর্তৃক উপস্থাপিত বাজেটগুলো। প্রস্তাবিত ২০১৬-১৭-এর বাজেট আসলে ব্যবসাবান্ধব, বিত্তবান-বান্ধব, পুঁজিবান্ধব, মোটেও দরিদ্রবান্ধব নয়। বাজেট মোটেও উচ্চাভিলাষী নয়। তবে বাস্তবায়ন সক্ষমতার নিরিখে অবশ্যই উচ্চাভিলাষী। কারণ বিগত বছরগুলোতে উন্নয়ন ও রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা কখনই অর্জিত হয়নি। উন্নয়ন বাজেটের ৬০ শতাংশের কম বাস্তবায়িত হয়েছে। এ অবস্থার পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। আর তা যত দ্রুত হবে ততই মঙ্গল।
লেখক : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়