বালিশ মিষ্টির টানে নেত্রকোনা
কেন খাবেন এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি?

বাংলাদেশের মানচিত্রে নেত্রকোনার পরিচিতি শুধু হাওর বা প্রকৃতির সৌন্দর্যে নয়, বরং একটি বিশেষ মিষ্টির জন্য যার নাম 'বালিশ মিষ্টি'। আনুমানিক ১১০ বছর আগে নেত্রকোনা শহরের বারহাট্টা রোড এলাকায় যার জন্ম। এই মিষ্টি দেখতে অনেকটা কোল বালিশের মতো, আর তাই রসিক জনতা এর নাম দিয়েছে 'বালিশ মিষ্টি'।
ফুড ট্র্যাভেলারদের জন্য এই বালিশ মিষ্টি কেন এক 'মাস্ট-ট্রাই' আইটেম, চলুন জেনে নেওয়া যাক সেই ইতিহাস, স্বাদ ও ঐতিহ্য।
ইতিহাসের পাতায় 'বালিশ মিষ্টি'র জন্মকথা
এই মিষ্টির আবিষ্কারক হলেন স্থানীয় মিষ্টান্ন প্রস্তুতকারক গয়ানাথ ঘোষ। গয়ানাথ ঘোষ নতুন কিছু তৈরির চিন্তা থেকে দুধের ছানা দিয়ে বড় আকারের মিষ্টির কাঠামো তৈরি করেন, যা দেখতে অনেকটা কোল বালিশের মতো ছিল। মিষ্টিটি তৈরি হলেও এর নাম ঠিক করা যাচ্ছিল না। অবশেষে, বালিশের মতো দেখতে হওয়ায় এলাকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব মরহুম আব্দুস সালাম পেয়ার মিয়া এর নাম দেন 'বালিশ মিষ্টি'। সেই থেকে এই নামেই পরিচিতি পায় এই ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি।
দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই গয়ানাথ ঘোষ ভারতে চলে যান, তবে তাঁর হাতে তৈরি এই রেসিপি শিখে নেন তাঁর কারিগর নিখিল চন্দ্র মোদক। বর্তমানে তাঁর তিন ছেলে বাবুল চন্দ্র মোদক, দিলীপ চন্দ্র মোদক ও খোকন চন্দ্র মোদক তাঁদের পৈতৃক 'শ্রীকৃষ্ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার' এ সেই ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন। তাঁরাই নেত্রকোনার এই খাদ্য ঐতিহ্যের তৃতীয় প্রজন্ম।

স্বাদের রহস্য: দেশি দুধ ও ক্ষীরের প্রলেপ
নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টির স্বাদ অন্য যেকোনো মিষ্টির থেকে আলাদা হওয়ার প্রধান কারণ হলো এর তৈরির বিশেষ প্রক্রিয়া এবং মান বজায় রাখার অঙ্গীকার।
মূল কারিগর বাবুল চন্দ্র মোদকের মতে, বালিশ মিষ্টি তৈরি করতে প্রয়োজন মূলত তিনটি উপাদান খাঁটি দেশি গাভীর দুধ, চিনি ও ময়দা। তাঁদের দাবি, খাঁটি দেশি গাভীর দুধ ছাড়া বালিশ বানালে প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায় না। তবে বিশেষ কৌশল হল প্রথমে দুধ থেকে ছানা তৈরি করে তা ময়দার সঙ্গে মিশিয়ে মণ্ড বানানো হয়, যা দিয়ে তৈরি হয় বালিশ মিষ্টির আকার। ভাজার পর এই বালিশ মিষ্টিকে ডোবানো হয় চিনির শিরায়। পরিবেশনের আগে বালিশের ওপরে এক ধরনের সুস্বাদু ঘন ক্ষীর বা দুধের মালাইয়ের মোটা প্রলেপ দেওয়া হয়, যা এর স্বাদকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়।

বালিশ মিষ্টি কেন জিআই-স্বীকৃত এবং অপরিহার্য?
সাম্প্রতিক সময়ে নেত্রকোনার এই ঐতিহ্যবাহী 'বালিশ মিষ্টি' জিআই (Geographical Indication) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছে। এই প্রাপ্তি নেত্রকোনাবাসীর জন্য এক বিরাট গর্বের বিষয়। জিআই স্বীকৃতি পাওয়ায় এর ঐতিহ্য ও স্বকীয়তা আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত হলো।
ঈদ, পূজা, জন্মদিন, বিয়ে নেত্রকোনার যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠান, উৎসব ও উপহার-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ এখন এই বালিশ মিষ্টি। স্থানীয় মানুষের কাছে এটি কেবল খাবার নয়, এটি আতিথেয়তা ও ভালোবাসার প্রতীক।
কেউ নেত্রকোনায় বেড়াতে এলে রসনাতৃপ্তির জন্য বালিশ মিষ্টির কথা সবার আগে মনে আসে। অনেকেই প্রিয়জনদের জন্য সযত্নে এই মিষ্টি সঙ্গে করে নিয়ে যান। এমনকি প্রবাসীরাও বিদেশযাত্রার সময় সঙ্গে নিয়ে যান এই বালিশ মিষ্টি, যা দূর প্রবাসে দেশের ঐতিহ্য ও স্বাদ বহন করে।
বালিশ মিষ্টি বর্তমানে ছোট আকারের পাশাপাশি ১০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকা দামের বড় আকারেও পাওয়া যায়, যা অর্ডার দিয়ে বানাতে হয়। তাই, আপনি যদি একজন সত্যিকারের ফুড ট্র্যাভেলার হন এবং একটি অঞ্চলের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে খাবারের মাধ্যমে অনুভব করতে চান, তবে নেত্রকোনার এই জিআই-স্বীকৃত 'বালিশ মিষ্টি' অবশ্যই আপনার খাদ্যতালিকার শীর্ষে থাকা উচিত। এটি আপনাকে দেবে এক স্মরণীয় ও তৃপ্তিদায়ক ভ্রমণের অভিজ্ঞতা।