মাথা-ঘাড়ের ক্যানসারের দ্বিগুণ কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কার

মাথা ও ঘাড়ের ক্যানসারের বর্তমান চিকিৎসা পদ্ধতির দ্বিগুণ কার্যকরী ওষুধ আবিষ্কারের দাবি করেছেন একদল গবেষক। সম্প্রতি আমেরিকান সোসাইটি অব ক্লিনিক্যাল অনকোলজির বার্ষিক সম্মেলনে এই সংক্রান্ত গবেষণাটি উপস্থাপন করা হয়। এই আবিষ্কারকে চিকিৎসা বিজ্ঞানে দুই দশকের সবচেয়ে যুগান্তকারী সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান এমন খবর দিয়েছে।
নতুন আবিষ্কৃত ইমিউনোথেরাপি ওষুধ পেমব্রোলিজুম্যাব শরীরের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সক্রিয় করে তোলে। এটি রোগীর দেহের একটি নির্দিষ্ট প্রোটিনকে লক্ষ্য বানিয়ে কাজ করে, যা ক্যানসার কোষ ধ্বংসে সহায়তা করে।
একটি পরীক্ষামূলক গবেষণায় (ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল) দেখা গেছে, নতুন আবিষ্কৃত ওষুধটি কিছু রোগীর ক্ষেত্রে ৫ বছর পর্যন্ত ক্যানসার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। অথচ, প্রচলিত চিকিৎসার সঙ্গে দেওয়া হলে সেটি ৩০ মাস পর্যন্ত কার্যকর ছিল।
এই পরীক্ষায় ২৪টি দেশের ১৯২টি এলাকা থেকে ৭০০ জন রোগী অংশগ্রহণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটি স্কুল অব মেডিসিন বিভাগের গবেষকদল এই গবেষণা পরিচালনা করেন। এতে সহ-গবেষক ও অনকোলজির অধ্যাপক ড. ডগলাস অ্যাডকিনস বলেন, ‘এই প্রথম এ রকম কোনো ওষুধে এমন প্রভাব দেখা গেছে। এটি একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও চমকপ্রদ সাফল্য।
ক্যানসার বা ক্যানসারজনিত রোগের গবেষণা, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা ও প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করেন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনকোলজি শাখা। এই ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের অনকোলজিস্ট বলা হয়।
বিশ্বব্যাপী গবেষকরা এরমধ্যেই ওষুধটি মাথা ও ঘাড়ের ক্যানসারের আধুনিক প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহার শুরু করেছেন।
প্রতিবছর লাখ লাখ মানুষ এই ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হন। ৭১৪ জন রোগীর ওপর চালানো এই ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় ৩৬৩ জনকে পেমব্রোলিজুম্যাব দেওয়ার পরে প্রচলিত চিকিৎসা দেওয়া হয়।
বাকি ৩৫১ জনকে শুধু প্রচলিত চিকিৎসা— টিউমার অপসারণের জন্য অস্ত্রোপচারের পর রেডিওথেরাপি, মাঝে মাঝে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়। মাথা ও ঘাড়ের ক্যানসারের প্রচলিত চিকিৎসা গত ২০ বছরে বদলায়নি। এসব রোগীর অধিকাংশ পাঁচ বছরও বাঁচেন না।
এই ইমিউনোথেরাপি বিশেষ করে পিডি-এল১ নামের ইমিউন মার্কারের (মানুষের শরীরের রোগ প্রতিরোধকারী জৈবিক উপাদান বা প্রোটিন) উচ্চমাত্রায় থাকলে বেশি ভালো কাজ করেছে। তবে সব ধরনের গলা ও মুখের ক্যানসার আক্রান্তদের ক্ষেত্রেই এটি রোগের সম্পূর্ণ নিরাময় বা ক্যানসার কোষ ছড়ানো বন্ধ করেছে।
লন্ডনের ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চের বায়োলজিকাল ক্যানসার থেরাপির অধ্যাপক কেভিন হ্যারিংটন যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা দলের নেতৃত্ব দেন। এই পরীক্ষায় অর্থায়ন করেছে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান এমএসডি।
তিনি বলেন, ‘এই ইমিউনোথেরাপি যেসব রোগীর ক্যানসার ছড়িয়ে পড়েছে বা ফিরে এসেছে, তাদের জন্য দারুণ কার্যকর। তবে এবারই প্রথমবারের মতো নতুন রোগীদের ক্ষেত্রে কার্যকারিতা প্রমাণিত হয়েছে।’
‘ক্যানসার কোষ ছড়ানো শুরু হলে এর চিকিৎসা অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। তবে, ইমিউনোথেরাপি ক্যানসার কোষ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়। এই গবেষণায় এটি প্রমাণিত হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে— পেমব্রোলিজুম্যাব রোগীদের প্রচলিত চিকিৎসার তুলনায় অনেক বেশি সময় রোগমুক্ত অবস্থায় রাখে। যাদের শরীরে ইমিউন মার্কার বেশি, সেসব রোগীর ওপর এটি সবচেয়ে ভালো কাজ। তবে আশার কথা হলো, ইমিউন মার্কারের মাত্রা যা-ই হোক না কেন, এই ওষুধটি মাথা ও গলার ক্যানসারে আক্রান্ত সব রোগীর ক্ষেত্রেই চিকিৎসার ফলাফল উন্নত করেছে।’
ডার্বিশায়ারের ৪৫ বছর বয়সী লরা মার্সটন ২০১৯ সালে স্টেজ-৪ জিভের ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে এই পরীক্ষায় অংশ নেন। তিনি বলেন, ‘ছয় বছর পর, আমি এখনো বেঁচে আছি! এটি ভাবতেই অবাক লাগছে। এই চিকিৎসা আমাকে জীবন ফিরিয়ে দিয়েছে।’
ইনস্টিটিউট অব ক্যানসার রিসার্চ-এর প্রধান নির্বাহী অধ্যাপক ক্রিস্টিয়ান হেলিন বলেন, ‘ইমিউনোথেরাপি বারবার নতুন সম্ভাবনা দেখাচ্ছে। যেসব রোগী এই চিকিৎসা পেয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে গড় রোগমুক্ত থাকার সময় দ্বিগুণ হয়েছে। এমনকি অনেকের ক্যানসার আর ফেরেনি। এটি খুবই যুগান্তকারী।’