বিশ্ব অ্যাজমা দিবস
নিয়ন্ত্রণ আপনার হাতে

বিশ্বব্যাপী অ্যাজমা বা হাঁপানি নিয়ে কাজ করে গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ ফর অ্যাজমা (গিনা)। গিনার মতে, প্রতিবছর প্রায় ৩০ কোটি মানুষ অ্যাজমা রোগে ভোগে। তবে দেখা গেছে, উন্নয়নশীল দেশে এই রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি হয়। এক জরিপে দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ অ্যাজমা বা হাঁপানিতে ভুগছে। সব বয়সের মানুষ অ্যাজমা নামক এই মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হয়। এ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তিরা শ্বাসকষ্টে ভোগেন মারাত্মক হারে, তাঁদের স্বাভাবিক কাজকর্মও ব্যাহত হয় এ জন্য। মাঝেমধ্যে অ্যাজমা গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে, তখন আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। অ্যাজমার ভয়াবহতা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য প্রতিবছর বিশ্বব্যাপী অ্যাজমা দিবস পালন করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আজ ৫ মে পালিত হচ্ছে এ দিবস। এবারের প্রতিপাদ্য ‘আপনিই পারেন অ্যাজমা বা হাঁপানিকে নিয়ন্ত্রণ করতে’।
অ্যাজমা হলো শ্বাসতন্ত্রের রোগ। অ্যালার্জিজনিত কারণে শ্বাসনালি সংকুচিত হয়ে যাওয়ায় দেখা দেয় অ্যাজমা। আক্রান্ত ব্যক্তির বুকের মধ্যে শোঁ শোঁ শব্দ, শ্বাসকষ্ট, বুকে চাপ লাগা বা টাইটনেস ও কাশি থাকে। সবার সব লক্ষণ থাকে না। সাধারণত এই চারটির একাধিক থাকলে তা রোগনির্ণয়ের পক্ষে যায়। এই উপসর্গগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে দেখা যায়। সাধারণত রাতে বা ঘুম থেকে জাগার পর উপসর্গ বেশি হয়। এ ছাড়া শারীরিক পরিশ্রম, অ্যালার্জি, ঠান্ডা বাতাস, ভাইরাস ইনফেকশনের পর উপসর্গ বেশি প্রকাশ পায়।
অ্যাজমা দীর্ঘমেয়াদি রোগ, কিন্তু নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। অ্যাজমা চিকিৎসায় বেশ ভালো ভালো ওষুধ আছে। আপনি আপনার চিকিৎসকের পরামর্শে এ ওষুধগুলো সেবন করে সুস্থ থাকতে পারেন। শুধু তাই নয়, আপনি একজন স্বাভাবিক মানুষের মতোই কাজকর্ম, চলাফেরা করতে পারবেন। শ্বাসের টান মারাত্মক আকার ধারণ করবে না। তবে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া নিজে থেকে ডাক্তারি করা যাবে না। অ্যাজমার চিকিৎসা করা হয় ধাপে ধাপে। একবারেই সব ওষুধ দেওয়া হয় না। লক্ষণ বুঝে ওষুধ বাড়ানোর দরকার পড়ে। কোন ব্যক্তি কোন ডোজে সুস্থ থাকবেন, তা সবার ক্ষেত্রে এক নয়। তাই নিয়মিত চিকিৎসকের সঙ্গে পরামর্শ করতে হবে। কোন ডোজে আপনি সুস্থ থাকছেন, সেটি ঠিক হয়ে গেলে ৩ থেকে ১২ মাস পরপর দেখা করতে হবে। আবার আপনি কোনো ডোজে যদি পরোপুরি তিন মাস সুস্থ থাকেন, তাহলে আস্তে আস্তে ওষুধের ডোজ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। অনেকে ভুল করেন। নিয়মিত চিকিৎসক পরিবর্তন করতে থাকেন। এতে কিন্তু ক্ষতি ছাড়া লাভ হয় না। প্রত্যেক চিকিৎসক তাঁর রোগীর চিকিৎসার একটি পরিকল্পনা করেন। কিন্তু এ পরিকল্পনার মাঝপথে যদি অন্য চিকিৎসককে দেখান, তাহলে তিনি আবার নতুন করে পরিকল্পনা শুরু করবেন। মাঝখান থেকে ক্ষতি হবে আপনার। পছন্দমতো একজন চিকিৎসক নির্ধারণ করে তাঁর পরামর্শই অনুসরণ করুন।
অ্যাজমার চিকিৎসায় ইনহেলার ব্যবহার করা হয়। অনেকে মনে করেন, ইনহেলার বুঝি শেষ চিকিৎসা। তাই চিকিৎসককে না জানিয়ে এর ব্যবহার বন্ধ করে দেন। বিপত্তি ঘটে এখানেই। মারাত্মক শ্বাসকষ্ট নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ছাড়া কিছু করার থাকে না। ইনহেলার খুবই আধুনিক একটি চিকিৎসা। এটি ব্যবহারে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া খুবই কম হয়। ওষুধ সরাসরি আক্রান্ত ব্যক্তির ফুসফুসে পৌঁছে বলে দ্রুত সুস্থ হওয়া সম্ভব। ওষুধের ডোজও কম লাগে। অনেক রোগীর ইনহেলার ব্যবহার করার পরও শ্বাসকষ্ট কমে না। তাঁদের ক্ষেত্রে যেটা বলা যায় তা হলো, তাঁদের ইনহেলার নেওয়ার পদ্ধতি ঠিক হয় নয়। তাই চিকিৎসকের কাছ থেকে অবশ্যই ইনহেলার ব্যবহার শিখে নেবেন।
ওষুধ ব্যবহারের পরও অ্যাজমা জটিল আকার ধারণ করতে পারে। ধূমপান তাদের মধ্যে অন্যতম। ধূমপান অবশ্যই বাদ দিতে হবে। আগামীকাল নয়, আজই। না হলে ওষুধ সেবন করতে থাকবেন আর শ্বাসকষ্ট বাড়তেই থাকবে।
স্থূলতার কারণেও শ্বাসকষ্ট বাড়তে থাকে। তাই ওজন কমিয়ে আনুন। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম বা ব্যায়াম করুন। আবার অতিরিক্ত ব্যায়াম নয়। শুরু করুন অল্প করে, ধীরে ধীরে বাড়ান এর পরিধি। শ্বাসকষ্ট হলে সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করুন ব্যায়াম।
ব্যথানাশক ওষুধ, অ্যাসপিরিন সেবন করলে অনেকের অ্যাজমা বাড়ে। কাজেই এগুলো সেবনে সাবধান। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যথার ওষুধ সেবন করবেন না।
অ্যালার্জি ও অ্যাজমা যেন এক মায়ের দুই সন্তান। অ্যালার্জি সৃষ্টিকারী অ্যালার্জেনগুলো হলো ফুলের রেণু, ঘরের ও পুরোনো ফাইলের ধুলা, কোনো কোনো ফলমূল-শাকসবজি-খাদ্যদ্রব্য, দূষিত বাতাস ও ধোঁয়া, বিভিন্ন ধরনের ময়লা, কাঁচা রঙের গন্ধ, ঘরের চুনকাম। এসব অ্যালার্জেন অ্যালার্জিক বিক্রিয়া করে হাঁপানি রোগের সৃষ্টি করে। হাঁপানি রোগীদের অবশ্যই এগুলো এড়িয়ে চলতে হবে।
মাইট নামক এক ধরনের অর্থোপড-জাতীয় জীব ঘরের অনেক দিনের জমে থাকা ধুলোবালিতে থাকে। হাঁপানির একটি প্রধান কারণ হচ্ছে ধুলো। বাসাবাড়িতে বিভিন্ন জায়গায় জমে থাকা ধুলোবালি, অফিসের খাতাপত্র বা ফাইলে জমে থাকা ধুলো এবং রাস্তাঘাটে প্রতিনিয়ত যে ধুলো উড়ছে, তা হাঁপানি বা শ্বাসকষ্টের প্রধান উদ্রেককারী। ঘরে বা অফিসে জমে থাকা ধুলো রাস্তার ধুলোর চেয়ে বেশি ক্ষতিকারক।
পুরোনো জমে থাকা ধুলো বা ময়লা হাঁপানির জন্য ক্ষতিকর। কারণ এতে মাইট, ফুলের রেণু, তুলার আঁশ, পোষা প্রাণীর লোম, ব্যাকটেরিয়া এবং বিভিন্ন প্রকার ছত্রাক মিশে থাকে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাইটের কারণেই প্রধানত ধুলোবালি অ্যাজমা রোগীদের জন্য বিপজ্জনক।
শহরে দূষিত বায়ুর কারণে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে। যাঁদের ধুলোর কারণে শ্বাসকষ্ট অ্যালার্জির সৃষ্টি হয়, তাঁদের কতগুলো বিষয়ের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে। এমন পরিবেশে চলা যাবে না, যেখানে ধুলোর পরিমাণ বেশি। ঘর পরিষ্কার এবং বিছানাপত্র ঝাড়ু দেওয়ার সময় মুখে মাস্ক ব্যবহার করতে হবে। বিভিন্ন খাদ্যের কারণেও হতে পারে অ্যালার্জি—গরুর মাংস, বোয়াল মাছ, চিংড়ি মাছ, পাকা কলা, আনারস, বেগুন, নারকেল, হাঁসের ডিম। গরুর দুধ শিশুদের অ্যালার্জির কারণ হতে পারে। ঠান্ডা পানীয় বা খাবার কোনো কোনো ব্যক্তির জন্য ক্ষতিকর হয়ে থাকে। তাই যেসব পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও খাদ্যদ্রব্য অ্যাজমা বা হাঁপানি সৃষ্টি করতে পারে, তা এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
ডা. হুমায়ুন কবীর হিমু : মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।