বর্ষাকালে শিশুদের রোগব্যাধি প্রতিরোধে

বর্ষাকালে শিশুদের বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধি হয়। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৪৯৪তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন অধ্যাপক ইসরাত জাহান লাকী। বর্তমানে তিনি বাংলাদেশ স্পেশালাইজড হাসপাতালের নিউনেটলজি অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক বিভাগের পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : শিশুদের কোন কোন রোগগুলো বেশি হচ্ছে?
উত্তর : মূলত পানিবাহিত রোগগুলো বেশি হয়। ডায়রিয়া, টাইফয়েড, তার পাশাপাশি এই ঋতুতে বাচ্চাদের ঠান্ডা-কাশি-জ্বরের প্রার্দুভাবও অনেক বেশি। ঠান্ডা-কাশি-জ্বর বেশিদিন থাকলে সেটি থেকে শ্বাসকষ্ট হতে পারে।
প্রশ্ন : বর্ষাকালীন এই সমস্যাগুলোর কারণ কী?
উ্ত্তর : ডায়রিয়ার জীবাণু প্রধানত পানির মাধ্যমে ছড়ায়। বর্ষাকালে যেহেতু পানি দিয়ে সব ভরে যায়। অনেক সময় গ্রামে সবাই পানিটা সেদ্ধ করে খায় না। নদী-নালা থেকে পানিটা খায়। অনেক সময় বন্যায় টিউবঅয়েল ডুবে যায়। এগুলো থেকে প্রধানত ডায়রিয়াটা হয়। আর ঠান্ডা কাশিতে দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু ভাইরাসের উপদ্রব বেশি থাকছে। এর মধ্যে একটি হলো ব্রঙ্কিওলাইটিস। এটি সাধারণত ঠান্ডা কাশি হালকা জ্বর দিয়ে শুরু হয়। এখানে যেটা দেখা যায় যে বাচ্চা সারা দিন খেলবে, বাচ্চা হাসবে তবে নিয়মিত কাশতে থাকবে। আর যখন কাশবে, দেখা যাবে বাঁশির মতো শব্দ হবে।
প্রশ্ন : একজন মা কখন বুঝতে পারবেন তাঁর বাচ্চাটার হাঁপানি আছে বা শ্বাসকষ্ট আছে?
উত্তর : কাশি তো মা বুঝতেই পারবে। একটি বাচ্চা যদি দেখা যায় রাতে ঘুমাচ্ছে না, কাশছে, ঘুমাতে পারছে না। বাচ্চার যদি দেখা যাচ্ছে জ্বর আসছে, যদি খাওয়াদাওয়া করছে না বা বাচ্চার যদি দেখা যায় শ্বাসপ্রশ্বাসের সঙ্গে কোনো শব্দ হচ্ছে, তখন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসতে হবে। আর যদি এগুলো কিছু না থাকে, যদি দেখা যায় যে নাক দিয়ে পানি পড়ছে, হালকা জ্বর- তখন মা চাইলে বাসাতেই এর চিকিৎসা করতে পারেন।
প্রশ্ন : যখন এই সমস্যাগুলো নিয়ে আসছে, আপনাদের কাছে, সেই্ ক্ষেত্রে আপনারা কীভাবে রোগটিকে নির্ণয় করছেন?
উত্তর : আসলে আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাচ্চার ঠান্ডা কাশি-জ্বর হলেই ভাবে নিউমোনিয়া। বাবা-মায়েরা এই বিষয়টিতে আসলে বোঝে না। আসলে বেশির ভাগ ঠান্ডা কাশি ভাইরাসজনিত কারণে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে কোনো ওষুধ লাগে না। তো আমাদের কাছে যখন মায়েরা আসেন, আমরা জিনিসটা বুঝিয়ে দিই। দুই বছরের নিচে যে ঠান্ডা-কাশিজ্বর হয়, একে আমরা ব্রঙ্কিওলাইটিস বলি। ব্রঙ্কিওয়ালাইটিসে আসলে কোনো রকম ওষুধ লাগে না। যেটা করতে হয় বাসায়, মা বাচ্চাকে একটু মাথা উঁচু করে শুইয়ে দেবেন। নাকটা পরিষ্কার রাখবেন। বাজারে সাধারণ স্যালাইনের একটি ড্রপ পাওয়া যায়, সেটি দিয়ে নাকটা পরিষ্কার রাখবেন। জ্বর মনে হলে প্যারাসিটামল দেবেন। বুকের দুধটা নিয়মিত করবেন। এবং বাচ্চাকে প্রতিদিন গরম পানি দিয়ে গোসল দেবেন। এগুলো মা বাসায় করবেন। তবে যদি দেখা যায় যে না বাচ্চা হঠাৎ করে খাওয়াদাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে, বাচ্চার শ্বাসপ্রশ্বাসের কষ্ট শুরু হচ্ছে বা বাচ্চা নেতিয়ে আছে, বাচ্চার অনেক বেশি জ্বর চলে আসছে, তখন আবার আমাদের কাছে নিয়ে আসতে হবে।
প্রশ্ন : নিউমোনিয়া নিয়ে একটি ভীতি কাজ করে। সেই ক্ষেত্রে সাধারণ শ্বাসকষ্ট বা নিউমোনিয়ার মধ্যে পার্থক্য কী?
উত্তর : পার্থক্য হলো সাধারণ শ্বাসকষ্ট যেটা বললাম, এখানে জ্বর খুব হালকা মাত্রায় থাকতে পারে না ও থাকতে পারে। বাচ্চা খেলাধুলা করবে, বাচ্চা খাবে, তবে কাশি হবে আর শব্দ হবে। আর নিউমোনিয়ায় বাচ্চার চার পাঁচদিন জ্বর থাকবে। জ্বর থাকার পরে শ্বাসকষ্টটা শুরু হবে। বাচ্চা দেখা যাবে খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দেবে। সবকিছুতে বিরক্ত থাকবে। কান্নাকাটি করতে থাকবে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপুষ্টি যেসব বাচ্চার তাদের এমন হয়। আর ব্রঙ্কিওলাইটিস যেটা আমি বলছি, এটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সুস্থ স্বাভাবিক বাচ্চাদের বেশি হয়।
প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে আপনাদের কাছে চিকিৎসার কী কী সুযোগ আছে?
উত্তর : নিউমোনিয়া যদি অত জটিল না হয়, আমরা রোগীকে অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিই। আর আমরা বলি যে দুদিন পরে বাচ্চাকে নিয়ে এসে যেন ফলোআপ করেন। আর ব্রঙ্কিওলাইটিস হলে ওভাবে কোনো চিকিৎসা লাগে না। মাকে শুধু ক্ষতিকর লক্ষণগুলো আমরা বলে দিই। কখন আমাদের কাছে নিয়ে আসতে হবে।
প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে কি সঙ্গে সঙ্গে বাচ্চাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন আছে?
উত্তর : জটিল অবস্থা যদি থাকে, বাচ্চা যদি কোনো কারণে নীল হয়ে যায়, বাচ্চার বুক যদি অনেক ডেবে যায়, বঙ্কিওলাইটিস জটিল হলে কেবল অক্সিজেন দেওয়া লাগে। সেটাও শুধু অক্সিজেনের জন্য।
প্রশ্ন : যেসব বাচ্চার জন্মগত হাঁপানি বা শ্বাসকষ্ট আছে তাদের বাসায় কীভাবে পরিচর্যা করবে?
উত্তর : জন্মগতভাবে কোনো শ্বাসকষ্ট থাকে না। যে পরিবারে হাঁপানি রোগ থাকে, যাদের অন্যান্য অ্যালার্জিক সমস্যা থাকে, ওদের বাচ্চাদের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ হতে পারে। সেটা দুই বছর না হলে আমরা হাঁপানি বলি না। যদি দুই বছর পর একটি বাচ্চার বছরে তিনবার শ্বাসকষ্ট হয়, বারবার কাশি হতে থাকে, তখন আমরা হাঁপানি বলি। হাঁপানি কিন্তু হঠাৎ করে খুব জটিল হয়ে যায়। সেই ক্ষেত্রে আমরা বাবা মাকে বলে দিই, একটি ইনহেলার বাসায় রাখতে। যদি এ রকম হয় ইনহেলার দিয়ে পার্শ্ববর্তী কোনো হাসপাতালে নিয়ে যেতে। যদি বেশি শ্বাসকষ্ট হয়।
অনেকের আছে যাদের এক মাস ধরেই কাশি ভালো হচ্ছে না বা প্রতি মাসে তিন-চারবার করে হচ্ছে, তখন এটি যেন না হয় এর জন্য প্রতিকারক হিসেবে কিছু ওষুধ আছে, যেগুলো আমরা দিয়ে থাকি।
আসলে কফ সিরাপ আমরা বাচ্চাদের দিতে মানা করি, অ্যাজমা বা ব্রঙ্কিওলাইটিস যেটাই হোক আমরা যদি অ্যান্টিহিসটামিন দিই, তাহলে শ্বাসনালিগুলো আরো চিকন হয়ে যায়। শ্বাসকষ্টটা আরো অনেক বেশি মাত্রায় বেড়ে যায়। এই জন্য কফ সিরাপ আমরা বাচ্চাদের দিই না। বাচ্চাদের শ্বাসকষ্টজনিত কারণে যদি দেওয়া লাগে সেখানে আমরা ব্রঙ্কডায়োলিটার দিই। সেটা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া আসলে দেওয়া উচিত নয়। সেই ক্ষেত্রে হরহামেশা কফ সিরাপ খাওয়ানোটা বন্ধ করতে হবে।
প্রশ্ন : এই সব রোগগুলো থেকে দূরে থাকতে কী করতে হবে?
উত্তর : সবার আগে যেটা করতে হবে বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়াতে হবে। বুকের দুধ খেলে বাচ্চার অপুষ্টি হয় না। বুকের দুধ খাওয়ালে বাচ্চার নিউমোনিয়া হওয়ার আশঙ্কা, ব্রঙ্কিওলাইটিস হওয়ার আশঙ্কা অনেক কমে যায়। আর অ্যাজমার বিষয়টি আলাদা। এখানে কিছু ট্রিগারিং বিষয় থাকে। ট্রিগারিং ফ্যাক্টর বলতে কিছু কিছু আছে যেমন ধুলায় গেলে হঠাৎ করেই অ্যাজমা হয়। কিছু আছে যেমন প্যাসিভ স্মোকিং। বাবা মা যদি ধূমপান করে এটি বন্ধ করতে হবে। আর কিছু আছে যেমন বসন্তকালে ফুলের রেণু থেকেও কিন্তু শ্বাসকষ্ট হয়। কিছু ওষুধ আছে যেগুলো শ্বাসকষ্টের জন্য দায়ী। আর কখনো কখনো দৌড়াদৌড়ি করার আগে বাচ্চার এমন হয়। তাই দৌড়াদৌড়ি করার আগে বাচ্চাকে ভ্যান্টোলিন পাফ নিয়ে তাকে খেলতে দিতে হবে।
প্রশ্ন : কী ধরনের পরিচর্যা করলে বাচ্চারা এগুলো থেকে দূরে থাকবে?
উত্তর : আসলে পরিচর্যার সঙ্গে বিষয়টি খুব বেশি সম্পর্কিত নয়। বুকের দুধের সঙ্গে সম্পর্কিত, পুষ্টির সঙ্গে সম্পর্কিত, ধূমপানের সঙ্গে সম্পর্কিত। তবে বাচ্চাকে প্রতিদিন গোসল করাতে হবে। পরিষ্কার রাখতে হবে। আর কোনো বাচ্চার যদি ঠান্ডা-কাশি হয়, ওদের কাছ থেকে একটু দূরে রাখতে হবে। আর ঢাকা শহরে আসলে দূষণ এত বেশি যে অ্যাজমা না থাকলেও ৪০ থেকে ৫২ ভাগ বাচ্চাদের রোগ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে আসলে সার্বিক সচেতনতা প্রয়োজন।