ওষুধ সেবনে সাবধান!

আমাদের দেশে ওষুধ খুবই সহজলভ্য। যেকোনো ওষুধ গলির দোকান থেকেই কিনতে পাওয়া যায়। আর আমাদের দেশে চিকিৎসকের তো অভাব নেই! রোগ হলেই হাজারজন এসে হাজারখানেক ওষুধের নাম বলবে আপনাকে। আমাদের মানসিক অবস্থাও এমন হয়েছে যে দুটো হাঁচি দিলেও মুঠোভর্তি ওষুধ না খাওয়া পর্যন্ত রোগ ভালো হয় না। বিনা কারণে ওষুধ সেবন করেন অনেকেই।
গ্রামগঞ্জে ও শহরে লাল রঙের গোল গোল ব্যথানাশক বড়ি সেবন করেননি এমন লোক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এ বড়ির নাম ডাইক্লোফেনাক। এ বড়ি সেবন করে পেটের নাড়ি বা অন্ত্র ফুটো হয়নি এমন লোকের সংখ্যাও কম নয়। প্যারাসিটামল তো দুধভাত। এর ফল কিন্তু ভালো নয়। ওষুধ যকৃতের মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। ছয় শতাধিক ওষুধ ও হারবাল সামগ্রী যকৃতের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে। এদের মধ্যে ব্যথানাশক ওষুধ, যেমন—ডাইক্লোফেনাক, ন্যাপ্রোক্সেন, আইবুপ্রোফেন, কিটোপ্রোফেন, অ্যাসপিরিন ও প্যারাসিটামল প্রধান।
২০০৫ সালে ওয়াশিংটন ইউনিভার্সিটির গবেষক অ্যানি লরসনের গবেষণায় জানা যায়, অ্যাকিউট লিভার ফেইলরের ৪২ শতাংশ কারণ অতিরিক্ত প্যারাসিটামল সেবন। প্যারাসিটামল সেবন যে কতটা মারাত্মক হতে পারে, তার প্রমাণ আমাদের দেশেও আছে। বছর দেড়েক আগে শতাধিক শিশু মারা গেছে যকৃত অকার্যকর হয়ে পড়ায়। এ শিশুদের অভিভাবক ও স্থানীয় হাতুড়ে চিকিৎসকরা শিশুদের ওই ওষুধ সেবন করান।
আমেরিকায় প্রতিবছর দুই হাজারজন মারা যায় অ্যাকিউট লিভার ফেইলরের কারণে। আর এর ৫০ শতাংশের পেছনে ওষুধ সেবন জড়িত। যকৃতের ক্ষতি করার কারণে আমেরিকার ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন নানা সময় বিভিন্ন ওষুধ বাজারজাতকরণ নিষিদ্ধ করে। গত কয়েক বছরে দুটি ওষুধ নিষিদ্ধ করে। একটি হলো ব্যথানাশক ব্রোমফেনাক। এটি হাড়ের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো। অন্যটি ডায়াবেটিসের ওষুধ ট্রোগ্লিটাজন।
গত বছরের এপ্রিলে এ প্রতিষ্ঠান থাইরয়েড নামক গ্রন্থির চিকিৎসায় ব্যবহৃত প্রোপাইলথায়োইউরাসিল সেবনের ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়েছে। যকৃতের ক্ষতি করতে পারে এমন ওষুধের মধ্যে আছে ব্যথানাশক ওষুধ, অ্যামোক্সাসিলিন, অ্যামায়োড্রোন, ক্লোরপ্রোমাজিন, ইরাইথ্রোমাইসিন, ফ্লুকোনাজন, জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল, অ্যাটোভ্যাসটেটিন, ক্যানসারের ওষুধ, যক্ষ্মা রোগের ওষুধ।
কিডনি বা বৃক্ক, যেটা আমাদের দেহ থেকে ক্ষতিকর পদার্থ বের করে দেয়, এতে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পায় শরীর। ওষুধ এ বিস্ময়কর অঙ্গটিরও ক্ষতি সাধন করতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, কিডনির রোগ ইন্টারস্টিশিয়াল নেফ্রাইটিসের ৭১-৯২ ভাগ কারণ ব্যথানাশক ওষুধ। কিডনির অকার্যকারিতার অন্যতম কারণ ইন্টারস্টিশিয়াল নেফ্রাইটিস।
আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, অ্যামাইনোগ্লাইকোসাইড অ্যান্টিবায়োটিক, যেমন—জেন্টামাইসিন, অ্যামিকেসিন, নিওমাইসিন, টোবরামাইসিন ব্যবহারে ১০-২০ ভাগ রোগী কিডনি বিকল হয়ে যায়।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের ওষুধ রেমিপ্রিল, ইনালাপ্রিল, ক্যাপটোপ্রিল, লেসিনোপ্রিল সেবনে কিডনির সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ জন্য আমেরিকান একাডেমি অব ফ্যামিলি ফিজিশিয়ান এ ওষুধ সেবনের কয়েক দিন পর কিডনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য সুপারিশ করেছে।
এছাড়া ক্লোরকুইন, রিউমাটয়েড আর্থ্রাইটিসের ওষুধ গোল্ড, পেনিসিলামিন, হাইড্রালাজিন, ইনফ্লাক্সিম্যাব, প্রোপাইল ইউরাসিল, অ্যান্টিবায়োটিক, ফ্লুকোনাজন অযথা সেবনে কিডনির ক্ষতির কারণ হতে পারে।
রাস্তাঘাটে হকাররা যৌনটনিক, যৌনরোগের ওষুধ, গায়ের রং ফর্সাকারী ওষুধ বিক্রি করে। রোগ না থাকলেও এগুলো দেদার কিনে খাচ্ছেন অনেকেই। এ ছাড়া হারবাল ওষুধেরও চলছে রমরমা ব্যবসা। শতাধিক গবেষণাপত্রের পরীক্ষালব্ধ ফল থেকে জানা গেছে, এ ধরনের ওষুধগুলো যকৃত বা লিভার ও কিডনির মারাত্মক ক্ষতি করে। কিডনি ও যকৃত বিকল হয়ে অল্প বয়সেই প্রাণ হারান অনেকে।
ওষুধ সেবনে সতর্ক হোন। অহেতুক কারণে ওষুধ সেবন করবেন না। চিকিৎসকের মতামত ছাড়া যেকোনো ওষুধই সেবন করা থেকে বিরত হোন।
লেখক : মেডিকেল অফিসার, ঢাকা মেডিকেল কলেজ।