স্বাস্থ্যসেবা খাতে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর ভূমিকা

বেসরকারি হাসপাতালগুলো বর্তমানে চিকিৎসাসেবায় অনেক এগিয়েছে। এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২৩৮৪তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ডা. শাগুফা আনোয়ার।
বর্তমানে তিনি ইউনাইটেড হাসপাতালের কমিউনিকেশন অ্যান্ড বিজনেস ডেভেলপমেন্ট বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত আছেন।
প্রশ্ন : স্বাস্থ্যসেবা খাতে বেসরকারি হাসপাতালের ভূমিকার বিষয়টি আসলে কী?
উত্তর : বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে হাসপাতালগুলোর যাত্রা বেশি দিনের পুরোনো নয়। ১০ থেকে ১২ বছরের আমরা বলতে পারি। খুব নিয়ম মেনে যেসব করপোরেট প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতাল এখন আমরা বাংলাদেশে দেখছি, এগুলোর ইতিহাস কিন্তু খুব পুরোনো নয়। এসব হাসপাতাল আসাতে স্বাস্থ্যসেবা খাতে বিরাট একটা পরিবর্তন এসেছে। পরিবর্তন এসেছে কয়েকভাবে। আগে আমাদের দেশের রোগীদের ক্ষেত্রে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার জন্য কেবলমাত্র সরকারি হাসপাতালগুলোর ওপর নির্ভর করতে হতো। আমরা জানি, সরকারের যথার্থ সদিচ্ছা থাকার পরেও সরকারের অনেক ধরনের সীমাবদ্ধতা থাকে। যেটা বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে আমরা পূরণ করতে পারছি। যেমন : উন্নত মানের চিকিৎসা প্রদান। যেসব চিকিৎসার সুবিধা আগে বাংলাদেশে ছিল না, এখন সেগুলো দেওয়া হচ্ছে। এসব খাতে পুরোপুরি আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসা আমরা সহজলভ্য করতে পারছি।
রোগীদের আগে নিরুপায় হয়ে বিভিন্ন কারণে চিকিৎসার জন্য বিদেশে চলে যেতে হতো এবং এ কারণে অনেক বিদেশি মুদ্রা আমরা হারাতাম, সেটা এখন সাশ্রয় হচ্ছে। দেশের টাকা দেশেই থাকছে। রোগীদের যে একটা ভোগান্তি হতো বিদেশে যাওয়ার জন্য, যাতায়াতের জটিলতা হতো, সেটা এখনো আছে।urgentPhoto
দূরের দেশ হোক কিংবা কাছের দেশ হোক, দালালের খপ্পরে পড়ে রোগীরা ভুল চিকিৎসা পেত এবং রোগীরা বিদেশে গিয়ে মারা গেলে ওই লাশ নিয়ে দেশে আসার যে একটি ভোগান্তি- সবকিছু মিলে বিষয়টি বেশ জটিল হতো। আর অতিরিক্ত টাকা-পয়সার বিষয়টি তো আছেই। সব কিছু মিলিয়ে রোগীদের যে ভোগান্তি হতো, তারপরও রোগীদের বিদেশে যেতে হতো। বাংলাদেশে আগে সেই ধরনের উন্নত চিকিৎসা ছিল না। এখন এই ক্ষেত্রে বিরাট একটি পরিবর্তন এনেছে এই বেসরকারি হাসপাতালগুলো। আন্তর্জাতিকমানের সেবা দেওয়ার জন্য প্রতিনিয়ত এই হাসপাতালগুলো চেষ্টা করে যাচ্ছে।
বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে আমার যে কাজের অভিজ্ঞতা, সেখান থেকে বলতে পারি, প্রতিনিয়ত হাসপাতালগুলো নিজেদের মানোন্নয়নের চেষ্টা করে আন্তর্জাতিকমানে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টা করছে। নতুন নতুন শাখা খুলছে। রোগীদের কী করে দেশের ভেতরে একটি দেশীয় পরিবেশে রেখে, রোগীর মন মানসিকতা বুঝে কাজ করতে পারবে সেই চেষ্টা করছে। তুলনামূলক কম খরচের মধ্যে কীভাবে চিকিৎসা দেওয়া যায়, সেটা চেষ্টা করা হচ্ছে। এসব দিক থেকে চিন্তা করলে গত ১২ বছরে যে পরিবর্তন এসেছে এটি যুগান্তকারী পরিবর্তন।
প্রশ্ন : রোগীদের মুখে অতিরিক্ত খরচের কথা শোনা যায়। এ ছাড়া ‘ভুল চিকিৎসা’ প্রচলিত একটি শব্দ- এসব বিষয়গুলোকে আপনি কীভাবে দেখবেন?
উত্তর : এগুলো যেগুলো আমরা শুনি সেগুলো তো কিছু হয়ই। কিছু না হলে আমরা শুনব কেন? তবে এসব ব্যাপারগুলোর মধ্যে আমি যেটি বলব, প্রথম যে ফাঁকটা আমি বলব, সেটা হলো ভুল বোঝাবুঝি। এখানে যোগাযোগের একটি ফাঁক আছে। এটি হচ্ছে, ডাক্তারের সঙ্গে রোগীর, হাসপাতালের সঙ্গে রোগীর। রোগীর সঙ্গে না, তবে হাসপাতালের সঙ্গে রোগীর আত্মীয়স্বজনের ভুল বোঝাবুঝি। এই ভুল বোঝাবুঝি থেকে গড়ে ওঠে একটি পারস্পরিক অবিশ্বাস। এটি হচ্ছে এখন একটি বড় অন্তরায়। এটা আমাদের কাটিয়ে উঠতে হবে। কাটিয়ে ওঠার দায়িত্ব আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে যারা কাজ করছে, হাসপাতালে, ডাক্তার হিসেবে প্রশাসনে যারা কাজ করছে, তাদের দিক থেকে আছে। আবার রোগীর তরফ থেকেও আছে। কী রকম? যেমন, আপনি যেটা বললেন অতিরিক্ত খরচের কথা। এখন অতিরিক্ত বলতে আমি কী বুঝি? একটি সরকারি হাসপাতালে যেখানে বিনা পয়সার চিকিৎসা দেওয়ার কথা, নাম মাত্রমূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার কথা, সেটার সঙ্গে তো বেসরকারি হাসপাতালের তুলনা করতে পারবেন না। এখানে কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে।
থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরের যে কোনো একটি হাসপাতালের সঙ্গে তুলনা করেন সব দিক দিয়ে আমরা হচ্ছি সমকক্ষ। ওই পরিমাণ বেশি বেতন দিয়ে ভালো চিকিৎসকদের নেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দেশি-বিদেশি নার্সদের নিয়ে সম্পূর্ণ উন্নত প্রযুক্তির চিকিৎসার সরঞ্জাম দিয়ে হাসপাতাল সাজানো হচ্ছে, সমস্ত প্রশিক্ষিত কর্মচারী দিয়ে আমরা চিকিৎসাসেবা দিচ্ছি। সেটার খরচকে তো সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে আসলে তুলনা করলে হবে না।
এমনকি আন্তর্জাতিক মানের হাসপাতালগুলোর সঙ্গে অন্যান্য যেসব ক্লিনিকগুলোকে দেখছি, সম্মান করেই বলছি, তাদের খরচের সঙ্গে তুলনা করলেও কিন্তু হবে না। কারণ এখানে অনেক খরচ হচ্ছে যেগুলো চোখে দেখা যায় না। যেমন, সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ। রোগের সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে এবং রোগের সংক্রমণ রোধে যে ধরনের নজরদারি আমরা করি, থিয়েটারে সুচারুভাবে একটা অস্ত্রোপচার হওয়ার জন্য, অস্ত্রোপচারের সময় যেন কোনো রোগ সংক্রমণ না হয়, এটা আমরা নিশ্চিন্তে দিতে পারি, যে ধরনের লোকজন রাখা হয়, যে ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় তার পেছনে খরচ আছে। তাই এই খরচটি তো আপনি আসলে সেভাবে তুলনা করতে পারবেন না। কাজেই আমি যেটা বলি, দেখতে হবে আপনি যে সেবা পেয়েছেন, সেই তুলনায় আপনার খরচটা ঠিক যুক্তিযুক্ত ছিল কি না।
আপনি যদি আন্তর্জাতিকমানের সেবা পান, আপনি সিঙ্গাপুর, ভারতে, ব্যাংককে যে ধরনের পয়সা খরচ করতে রাজি, সেই টাকাটার চেয়ে আমরা শতকরা ১০ থেকে ২০ ভাগ খরচ কম নিচ্ছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরো কম নিচ্ছি। তাহলে তো আমি বলব সেই একই পরিমাণ আন্তর্জাতিক মানের সেবা দিয়ে আমরা তো অতিরিক্ত নিচ্ছি না। অতিরিক্ত চার্জ আসলে হচ্ছে না। বরং অনেক কমই হচ্ছে।
আরেকটি যেটি আপনি বললেন ভুল চিকিৎসা। ভুল চিকিৎসার বিষয়টি সব সময়ই ছিল। ভুল চিকিৎসা সব জায়গায় হতে পারে। ভুল চিকিৎসা হচ্ছে- এটা কি রোগী বলছে? রোগী কি একজন ডিগ্রিপ্রাপ্ত, প্রশিক্ষিত চিকিৎসকের ভুল ধরার বিষয়ে অভিজ্ঞ। এটা যদি অন্য কোনা চিকিৎসক বা ফোরাম যাচাই করে, যদি বলে ভুল, তাহলে অবশ্যই ভুল চিকিৎসার বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিয়মকানুন আছে, সরকারি স্বাস্থ্যবিধিমালা আছে, সেই নিয়মে হবে। কিন্তু এই যে আমার পছন্দমতো কিছু না হলেই সেটাকে ভুল বলে ফেলা, সেটা ঠিক নয়।
হাসপাতাল চেষ্টা করবে, যাতে সঠিক চিকিৎসা দেওয়া হয়, ভুল চিকিৎসা দেওয়া না হয়, যেন সঠিকভাবে রোগীর আত্মীয়স্বজনকে বোঝানো হয়। রোগীকে ভালো করার জন্য যে চেষ্টা তার সবটাই করা হয়। কিন্তু অতটুকুই। এর বেশি তো করা সম্ভব নয়। রোগীকে একদম ভালো করে দেওয়ার গ্যারান্টি বা রোগী সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে যাবে, এমনকি মুমূর্ষু রোগীর গ্যারান্টি দেওয়া তো সম্ভব নয়। তবে হচ্ছে না, সেটি নয়, প্রচুর রোগীর আমি বলব উন্নতি হয়েছে। আমাদের চিকিৎসকরা অত্যন্ত দক্ষ। সুদক্ষ ব্যবস্থাপনায় মুমূর্ষু রোগীরা ভালো হয়ে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। এগুলো হচ্ছে। আমাদের দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা অনেক উন্নত হয়েছে। তবে কোনো গ্যারান্টি তো আমরা দিতে পারব না। আমরা শুধু চেষ্টা করতে পারব। আসলে ভুল চিকিৎসার বিষয়ে একটি ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ রয়ে গেছে।
প্রশ্ন : বিশেষায়িত সেবাগুলোর মধ্যে কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা আন্তর্জাতিক মানে এসেছি? এ ছাড়া বেসরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি সরকারি হাসপাতালগুলোতেও কিন্তু বেশ কিছু বিষয়ে আন্তর্জাতিক সেবা আমরা পাচ্ছি। এই ক্ষেত্রে আপনি কী বলবেন?
উত্তর : ওই যে বললাম, একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে আমাদের স্বাস্থ্যসেবা খাতে। সামনেও আসবে আশা করি। আপনি ঠিকই বলেছেন, বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা খাতে যেই চিকিৎসা এসেছে, পাশাপাশি আমাদের বিভিন্ন স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল আছে, সেগুলোতে সরকারের উদ্যোগও অবশ্যই প্রশংসনীয়।