নারীদের ইউরিনারি ট্র্যাক্ট সংক্রমণ কেন বেশি হয়

ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন বা ইউটিআই অনেকেরই হয়ে থাকে। তবে এই রোগে নারীদের বেশি আক্রান্ত হতে দেখা যায়। এ বিষয়ে কথা বলেছেন ইউনাইটেড হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের পরামর্শক ডা. তানভির বিন লতিফ।
এনটিভির নিয়মিত আয়োজন ‘স্বাস্থ্য প্রতিদিন’ অনুষ্ঠানের ২৩১৭তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি।
প্রশ্ন : ইউটিআই মানে কী? কোন অংশে সাধারণত এই সংক্রমণ হয়ে থাকে?
উত্তর : আমাদের প্রথমে জানতে হবে ইউরিনারি ট্র্যাক্ট কী, সেই বিষয়ে। আমরা সবাই জানি, আমাদের দুটো কিডনি রয়েছে। এই কিডনি থেকে দুটো নল বের হয়ে মূত্রথলিতে আসে। মূত্র থলি থেকে আরেকটি নল—ইউরেথ্রার মাধ্যমে প্রস্রাব বের হয়। এই যে পুরো ট্র্যাক্ট বা যাত্রাপথ যেখানে ইউরিন শুরু হয়ে বের হয়ে গেল—এই পুরো জায়গাকে আমরা বলি ইউরিনারি ট্র্যাক্ট। কিডনি থেকে শুরু করে ইউরেথ্রা, যেখানে মূত্রটাকে ত্যাগ করলাম সেই পর্যন্ত পুরো অংশটুকু। এর যেকোনো অংশ যদি সংক্রমণ হয়, একে বলা হচ্ছে ইউটিআই বা ইউরিনারি ট্র্যাক্ট সংক্রমণ।
প্রশ্ন : একজন মানুষ সাধারণত এই সংক্রমণে আক্রান্ত হন কেন?
উত্তর : এই সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার নানা রকম কারণ রয়েছে। সাধারণত দেখা যায়, সারা পৃথিবীতেই এই সংক্রমণটা নারীদের একটু বেশি হয়। পুরুষের তুলনায় নারীদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা বেশি।
এর কারণ হলো, নারীদের ইউরেথ্রা বা মূত্রথলির পরের যেই অংশটা সেটা ছোট। এই কারণে সমস্যাটি নারীদের একটু বেশি হয়। পুরুষদেরও হয়। এ ছাড়া অন্যান্য বেশ কিছু কারণ রয়েছে।
নারীদের ক্ষেত্রে অরিফিস ও পায়খানার রাস্তা কাছাকাছি হয়, সে জন্যও সংক্রমণ বেশি হতে পারে। এ ছাড়া পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার একটি বিষয় রয়েছে।
যাদের আরো কিছু অসুখ থাকে, যেমন—কারো ডায়াবেটিস যদি থাকে, কারো যদি কিডনির পাথর থাকে, অথবা ইউরিনারি ট্র্যাক্টের মধ্যে এনোমালিস বা গঠনটা একটু অন্য রকম থাকে; তাদের ক্ষেত্রে এই সমস্ত সংক্রমণ বেশি হয়। আবার অনেকে স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ খান তাদের হতে পারে। এ ছাড়া অন্যান্য অসুখ থাকে, যেমন—ম্যালিগন্যানসি বা ক্যানসার, সেসব রোগীর ক্ষেত্রে দেখা যায় সংক্রমণের সংখ্যা সাধারণ মানুষের তুলনায় বেশি হয়।
প্রশ্ন : নারীদের ক্ষেত্রে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি কী? আরেকটি হচ্ছে, দীর্ঘ সময় ধরে কেউ যদি প্রস্রাব আটকে রাখে তাতে কি এই সংক্রমণ বাড়ে?
উত্তর : আপনি ঠিকই বলেছেন, সাধারণত মহিলাদের একটি কারণ তো ইউরেথ্রা ছোট হওয়া। সেই বিষয়ে তো কিছু করার নেই। তাহলে আর যেসব কারণ আছে এর মধ্যে একটি হলো পানি কম খাওয়া। আবার পানি যদি খাওয়াও হয় বিশেষ করে যাঁরা কর্মজীবী নারী, তাঁদের বাথরুমের অভাব রয়েছে। তাঁরা অনেক সময়ই বাথরুম পান না বলে দীর্ঘ সময় বাথরুমে যাচ্ছেন না। যদি মূত্রথলির মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে প্রস্রাব আটকে থাকে, তাহলে তাঁদের সংক্রমণ হওয়ার আশঙ্কা বেশি হয়।
আমরা যখন পায়খানা করি, এরপর পরিষ্কারের একটি বিষয় রয়েছে। পরিষ্কার ভালোভাবে হতে হবে। এমনভাবে পরিষ্কার করতে হবে, যেন মলদ্বার সামনে না আসে। এ ছাড়া সাধারণ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতাগুলো মেনে চলতে হবে এবং স্বাস্থ্যসম্মতভাবে চলতে হবে।
প্রশ্ন : ইউটিআই হলে কী লক্ষণ দেখা দেবে?
উত্তর : ইউটিআই মানে হলো ইউরিনারি ট্র্যাক্টের ব্যাকটেরিয়াজনিত সংক্রমণ। এ ছাড়া নানা রকম জীবাণুর মাধ্যমে হয়ে থাকে। লক্ষণগুলোকে আমরা দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। আপার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট সংক্রমণ আর কিডনি বা তার কাছাকাছি নল যেটি রয়েছে সেটি লোয়ার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন।
লোয়ার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট সংক্রমণ খুব প্রচলিত। সেই ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগীর ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ হয়। প্রস্রাবের জ্বালাপোড়া হয়। তলপেটে ব্যথা হয়। কারো কারো ক্ষেত্রে জ্বর আসে। এই চারটা উপসর্গ সব সময় যে একসঙ্গে হতে হবে, সেটি কিন্তু নয়। হয়তো দু-একটা লক্ষণ কারো ক্ষেত্রে দেখা দিতে পারে। এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, এটি লোয়ার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট সংক্রমণ। কখনো যদি কিডনি বা এর আশপাশের অংশে সংক্রমণ হয়, তখন দেখা যায় পিঠে বা কোমরে ব্যথা হয়। যেকোনো এক পাশে বা দুই পাশেই এবং তার সঙ্গে যদি অনেক অনেক জ্বর হয়। এগুলো ইউরিনারি ট্র্যাক্ট সংক্রমণের লক্ষণ।
প্রশ্ন : বিশেষ করে কোমরের পেছন দিকে, ওপরের দিকে ব্যথা হলে আমরা একটু আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ি যে কিডনির সমস্যা কি না। কিডনির সমস্যাকে আমরা খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিই। এটা ভালো লক্ষণ। তবে এই লক্ষণ নিয়ে আসার পর দেখলেন যে আসলে সমস্যাটি ইউটিআই। তখন করণীয় কী?
উত্তর : কোমরে ব্যথা আমাদের হতেই পারে। সেটার কারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কিন্তু কিডনি রোগ নাও হতে পারে। অনেক সময় হয়তো একভাবে বসে আছি অথবা নতুন কোনো খেলাধুলা করলাম, অথবা বিছানার ম্যাট্রেসটা উঁচু-নিচু, তাতেও কিন্তু কোমরে ব্যথা হতে পারে। আরো অনেক কারণ রয়েছে। সেই ক্ষেত্রে আতঙ্কগ্রস্ত হওয়ার আসলে তেমন কিছু নেই। সেটা হতেই পারে। তবে আপার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট সংক্রমণ সেই ক্ষেত্রে ব্যথা সাধারণত খুব তীব্র হয়, সঙ্গে অনেক জ্বর থাকে। সুতরাং এর মাধ্যমে আপনি বুঝতে পারবেন এটি সাধারণ কোমর ব্যথা নয়, বরং এটি হলো ইউরিনারি ট্র্যাক্ট সংক্রমণ।
প্রশ্ন : এর চিকিৎসা কি খুব সহজ না কি জটিল কিছু?
উত্তর : এটা আসলে নির্ভর করে যদি দেখা যায় যে লোয়ার ইউরিনারি ট্র্যাক্ট ইনফেকশন হয়েছে, খুব সহজেই আমরা বুঝতে পারছি কী কী জীবাণু দিয়ে হচ্ছে, তখন আমরা সাতদিনের জন্য একটি সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে এর চিকিৎসা করি। তবে মনে রাখতে হবে, এই অ্যান্টিবায়োটিক যেকোনো অ্যান্টিবায়োটিক নয়। এটি একজন চিকিৎসকের সিদ্ধান্ত নিয়ে খেতে হবে। ওষুধের কোর্স সম্পন্ন করলে অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভালো হয়ে যাবে। এটি আর থাকবে না। এরপর আপনাকে কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে।
প্রশ্ন : যদি সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক না খায় এবং যদি কোর্স সম্পন্ন না করে, তাহলে কী সমস্যা হতে পারে?
উত্তর : সমস্যা যেটা হতে পারে আপনি যদি চিকিৎসা শুরু করেন এবং অর্ধেকে শেষ করে দেন, তাহলে ওই সব জীবাণু থেকে যায়, পুরোপুরি নিরাময় হয় না। তখন ক্ষতি হয়। সাধারণভাবে হয়তো কিছু উপসর্গ থেকে নিজেকে রক্ষা করলেন এবং সাতদিনের কোর্স হয়তো তিনদিনে শেষ করে দিলেন। তাহলে দেখা যাবে ওই জীবাণু দিয়েই আবার সংক্রমণ হবে। তবে আগের অ্যান্টিবায়োটিক আর কাজ করবে না। কারণ, ওই জীবাণুগুলো অ্যান্টিবায়োটিক নিরোধী হয়ে গেছে। সেই ক্ষেত্রে আপনাকে আরো শক্তিশালী অ্যান্টিবায়োটিকের কাছে যেতে হবে। এগুলো যদি বারবার হতে থাকে তাহলে ইউরিনারি ট্র্যাক্টটা স্থায়ীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রশ্ন : ইউটিআই যদি যথাযথ চিকিৎসা না হয়, তাহলে কি কিডনিও বিকল হতে পারে?
উত্তর : হ্যাঁ, অবশ্যই হতে পারে। সুতরাং এটি বেশ গুরুত্বের সঙ্গেই নেওয়া উচিত।