পুড়ে গেলে ডিম বা পেস্ট লাগানো কি ঠিক?

পুড়ে গেলে অনেক সময়ই পেস্ট, ডিম বা আলু লাগাতে দেখা যায়। আসলে কি সেটি ঠিক? আসলে পুড়ে গেলে প্রাথমিক অবস্থায় কী করণীয় সেই বিষয়ে কথা বলেছেন কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালের প্লাস্টিক সার্জন সহকারী অধ্যাপক ডা. ফুয়ারা তাসমিম পামি। আজ ২১ ডিসেম্বর এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২২৪২তম পর্বে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : পুড়ে যাওয়ার বিষটি যখন আসে, আমরা সাধারণভাবে বলি, আগুনে পুড়ে যেতে পারে, গরম পানিতে পুড়ে যেতে পারে, ইলেকট্রিক বার্ন হতে পারে, এমনকি পেট্রলবোমা দিয়ে পুড়ে যাওয়াও আমরা দেখি। বাংলাদেশে সাধারণত পুড়ে যাওয়ার ঘটনা কোনটি বেশি ঘটে?
উত্তর : আমাদের দেশে বেশি যদি বলি, সে ক্ষেত্রে গরম পানিতে পুড়ে যাওয়া এবং আগুনে পুড়ে যাওয়া- এ দুটোর পরিমাণ বেশি। এ ছাড়া ইলেকট্রিক বার্ন আছে। একটি ঘরের মধ্যে অথবা রাস্তায় যাঁরা কাজ করেন বা ইলেকট্রিক লাইনে কাজ করেন, নির্মাণকর্মী তাঁদের এ ধরনের সমস্যা হয়। তা ছাড়া রয়েছে কেমিক্যাল বার্ন। আমরা সবগুলোই পাই, তবে এর মধ্যে গরম পানি ও আগুনে পোড়াটা বেশি। তবে শীতকাল এলে এর প্রকোপটা বেড়ে যায়।
প্রশ্ন : একজন মানুষ হঠাৎ করে পুড়ে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে তার করণীয় কী? হয়তো হাত আগুনে পুড়ে গেলে কেউ ডিম ভেঙে দিয়ে দিচ্ছে, কেউ লবণ দিচ্ছে, কেউ পেস্ট দিচ্ছে- এ বিষয়ে আপনার মতামত কী? আর আসলে করণীয় কী?
উত্তর : এ রকম আমরা অনেককে পাই, যারা প্রথমে চিকিৎসকের কাছে আসে না। নিজেরাই প্রাথমিকভাবে এই কাজগুলো করে ফেলে। আমরা প্রথমেই বলি পোড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুনের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসতে হবে এবং তার শরীরের কাপড়, গয়নাগাটি খুলে ফেলতে হবে। এরপর সাধারণ পানি অর্থাৎ কলের পানি দিয়ে তাকে ধুতে হবে। প্রায় ২০ মিনিট থেকে ৩০ মিনিট ওটার নিচে ধরতে হবে। কারণ পোড়ার পরও ওই জিনিসটি আস্তে আস্তে ছড়াতে থাকে। পানি সেই জিনিসটিকে কমিয়ে আনে।urgentPhoto
আর যেটি বললেন, পেস্ট, ডিম বা আলু এগুলোর আসলে তেমন কোনো ভূমিকা নেই। অনেকে বলে ডিম সেই জায়গাটিতে ব্যবহার করার চেয়ে যেহেতু কিছু প্রোটিন আছে, সেটি খাওয়া বেশি জরুরি। তবে ওপরে দিলে কোনো লাভ নেই।
প্রশ্ন : এসব জিনিস দিলে কী সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে?
উত্তর : হ্যাঁ, এসব জিনিস দিলে সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ে। তা ছাড়া পেস্ট, ডিম এগুলো না দেওয়াই উত্তম।
প্রশ্ন : রোগী আপনাদের কাছে এলে আপনারা কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ করেন সে কতটা জটিল অবস্থায় রয়েছে?
উত্তর : আমাদের কাছে যখন রোগী আসে তখন বোঝার চেষ্টা করি কী পুড়ে গেছে এবং সেটা কতটুকু। এ জন্য রোগীর কাপড়চোপড় সরিয়ে তাকে দেখা দরকার হয় কতটুকু পুড়েছে এবং কী দিয়ে পুড়েছে। এর জন্য একটি চার্ট রয়েছে আমাদের। ওই চার্ট অনুযায়ী আমরা হিসাব করি যে কত শতাংশ পুড়েছে। সেটার ওপর নির্ভর করে রোগীকে ভর্তি রাখব নাকি বাসায় পাঠাব কিংবা তার পোড়াটি বেশি কি না, তার আইসিও সাহায্য লাগবে কি না ইত্যাদি। তা ছাড়া ইনহেলশন পোড়া যদি থাকে, একে জটিল বিষয় হিসেবে চিন্তা করা হয়। অনেক সময় সিলিন্ডার বিস্ফোরণ থেকে হয় বা চুলার আগুন থেকে হয়, হয়তো ঘরটা বন্ধ তখন এমন হয়। সে ক্ষেত্রে এটি শ্বাসের সঙ্গে চলে যায়। সেই জিনিসটি ক্ষতিকর হয়। তা ছাড়া মুখের যদি কোনো পোড়া থাকে বা গুরুত্বপূর্ণ কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুড়ে গেলে, সে ক্ষেত্রে এগুলোকে আমরা গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরি।
এ ছাড়া ১০ ভাগের নিচে, আর ১৫ ভাগের নিচে আগুনে পোড়ার ক্ষেত্রে আমরা বাড়িতে রেখেই চিকিৎসা করতে পারি। কারণ, তার জন্য কোনো আইভি স্যালাইন দেওয়া প্রয়োজন হয় না। এর বেশি হলে আমরা ভর্তি করব। ভর্তি করে আইভি স্যালাইন দেব, ইনজেকশন দেব, অ্যান্টিবায়োটিক এবং ব্যথার ওষুধ দিতে হবে। আমাদের দেশে ৪০ ভাগ বা তার বেশি হলে আমরা একে জটিল হিসেবে ধরি।
১৫ বা ৩০–৩৫ পর্যন্ত হলে মোটামুটি হাসপাতালে সামলানো যায়। এর চেয়ে বেশি হলে বা এর সঙ্গে যদি অন্য কোনো জটিলতা থাকে, যদি শ্বাসতন্ত্র পুড়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটে, তাহলে একটু জটিল হিসেবে ধরা হয়।
প্রশ্ন : পুড়ে যাওয়া রোগীদের বেলায়, যাদের ১০ ভাগ বা তার নিচে হয় তাদের সহজেই ভালো হচ্ছে। যারা ৩০ বা এর মধ্যে বার্ন হয়, তাদের সহজ সমাধান করতে পারছেন চিকিৎসা দিয়ে। আর বেশি পুড়ে গেলে, শ্বাসতন্ত্র পুড়ে গেলে তাদের বাঁচিয়ে রাখা কঠিন হয়। কিন্তু তাদের ভেতর একটি দুশ্চিন্তা কাজ করে পুড়ে গেলে তো চোখ, মুখ বিকৃত হয়ে গেল এ বিষয়ে তারা কী করবে। সেই খানে আপনাদের করণীয় কী রয়েছে?
উত্তর : হ্যাঁ, পুনর্বাসন এবং তাদের কাজে ফিরিয়ে দেওয়া একটি জরুরি বিষয় আমাদের জন্য। সে ক্ষেত্রে আমরা বলি প্রাথমিক অবস্থায় আশপাশের হাসপাতালে যাবেন। এরপর যাঁরা বার্ন বিশেষজ্ঞ, তাঁদের কাছে নিতে হবে। তাঁদের কাছে নিলে জটিলতাগুলো সহজে কমে আসে। যদি গভীর পোড়া হয় বা হাত জোড়া লেগে যায় বা মুখ পুড়ে যায়, যদি না শুকায়, সে ক্ষেত্রে আমরা স্কিন গ্রাফটিং করি। কোনো কোনো জায়গায় যদি স্কিন গ্রাফটিং সম্ভব না হয়, সে ক্ষেত্রে ফ্লাপ দিয়ে আমরা জোড়া লাগাই। তা ছাড়া যদি কনট্রাকচার হয়, সেখানে সার্জারি করে যতটুকু সম্ভব ঠিক করি। তবে অনেকে দেখা যায়, আগে হয়তো পুড়েছে, তবে সেই সময়ে ঠিকমতো চিকিৎসা নেয়নি। তারা পরে এসেছে, তখন অনেক ক্ষেত্রে সেটি আমাদের জন্য জটিল হয়ে যায়। তাদের সেই আশানুরূপ ফলাফল দিতে পারি না। সে ক্ষেত্রে সবাইকেই আমি বলব, সময়মতো যাতে চিকিৎসা নিতে আসে।