ভিটামিন ডি’র অভাবে কী করবেন?

ভিটামিন ডি’র ঘাটতি হলে দেহে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা হয়। এই ঘাটতি রোধে কী করণীয় এ বিষয়ে কথা বলেছেন স্কয়ার হাসপাতালের ইন্টারনাল মেডিসিন অ্যান্ড ডায়াবেটিসের পরামর্শক ডা. জাহাঙ্গীর আলম। আজ ১৪ ডিসেম্বর এনটিভির নিয়মিত আয়োজন স্বাস্থ্য প্রতিদিনের ২২৩৫তম পর্বে অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হয়।
প্রশ্ন : আমরা জানি আমাদের শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় অনেকগুলো ভিটামিন রয়েছে। এ বি সি ডি ই কে। এর মধ্যে একেকটি ভিটামিনের প্রয়োজনীয়তা একেক রকম। ভিটামিন ডি কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? এটা কেন এত আলোচনায় আসছে? ভিটামিন ডি আমাদের শরীরে প্রয়োজন কেন এবং এটা আমরা কীভাবে পূরণ করি?
উত্তর : ভিটামিন ডি হলো একটি ফ্যাট সলিউবল ভিটামিন। বয়স ভেদে বিভিন্ন রকম চাহিদা থাকে। যেমন এক বছর পর্যন্ত শিশুদের জন্য ৪০০ ইউনিট দরকার হয়, এটা জরুরি। ১৮ বছর পর্যন্ত ৬০০ ইউনিট। আর প্রাপ্তবয়স্কদের সাধারণত ৬০০ থেকে এক হাজার ইউনিট পর্যন্ত দরকার হয়। এই ভিটামিন ডি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা আগে জানতাম ভিটামিন ডি’র অভাবে সাধারণত বাচ্চাদের রিকেট হয়ে থাকে। ভিটামিন ডি’র কাজ হলো ইনটেসটাইন থেকে ক্যালসিয়াম ও ফসফেটকে শোষণ করে হাড়কে মিনারালাইজড করা, শক্ত করা। এখন ভিটামিন ডি যদি না থাকে ক্যালসিয়াম এবং ফসফেটটা একেবারেই শোষণ হতে পারছে না। এতেও আপনার হাড়গুলো নরম হয়ে যায়। বাচ্চা বয়সে এর অভাবে হয় রিকেট, আর বয়স্কদের সাধারণত অস্টিওমেলাসিয়া। তবে ইদানীং দেখা যাচ্ছে এটি নিয়ে অনেক কথাবার্তা হচ্ছে। এই ভিটামিন ডি’র অভাবে অনেক রোগ হতে পারে। মাথা থেকে শুরু করলে ডিমেনসিয়া, আলঝাইমার রোগ- এগুলোর সঙ্গে ভিটামিন ডি’র অভাবের সম্পর্ক আছে। এমনকি ডায়াবেটিসের সঙ্গেও সম্পর্ক আছে। অ্যাজমার সঙ্গে সম্পর্ক আছে। এ ছাড়া গর্ভবতী নারীর অপরিপক্ব শিশু হওয়া বা শিশুর বুদ্ধি কম হওয়া- এগুলোর সঙ্গে ভিটামিন ডি’র সম্পর্ক রয়েছে। পাশাপাশি ক্যানসারের সঙ্গে বা হার্টের রোগের সঙ্গেও এর বেশ সম্পর্ক আছে।
প্রশ্ন : সাধারণত ভিটামিন ডি’র উৎস কী? ভিটামিন ডি’র ঘাটতি হলে করণীয় কী?
উত্তর : আমাদের দেশে প্রচলিত যে খাদ্যগুলো আমরা খাচ্ছি এগুলোর মধ্যে ভিটামিন ডি অনেক কম। ভিটামিন ডি’র প্রধান উৎস হলো সূর্যের আলো। সকালবেলার সূর্যের আলোটা যদি চামড়ার ওপরে পড়ে, ২০ মিনিটি পর দেখা যাচ্ছে যে, চামড়ার নিচে যে কোলেস্টেরল আছে ওখান থেকে পরিবর্তন হয়ে ভিটামিন ডি তৈরি হয়ে যায়। ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ভিটামিন ডি এই উৎস থেকে আসে।
তা ছাড়া খাবারের ভেতরেও এই ভিটামিন আছে। যে খাবারগুলো আমরা সাধারণত এই দেশে পাই না। যেমন সামুদ্রিক মাছ, কর্ড মাছ, ম্যাকরিল, টুনা, সারদিনস এগুলো। তা ছাড়া পনিরের ভেতর আছে। ডিমের ভেতর আছে। তবে একটি ডিমের ভেতর থাকে মাত্র ৩০ ইউনিট। অনেকের একটি ভুল ধারণা আছে, দুধের মধ্যে ভিটামিন ডি পাওয়া যায়। এটাতে ক্যালসিয়াম থাকে। ভিটামিন ডি এতটা থাকে না। সুতরাং আপনাকে নির্ভর করতে হচ্ছে অনেকটা প্রকৃতির ওপর এবং তাও সকালের সূর্য। তবে আমাদের যে আধুনিকায়ন হচ্ছে, আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে যাচ্ছি, গাড়িতে যাচ্ছি, গাড়ি থেকে নেমে অফিসে যাচ্ছি। সুতরাং সকালের ওই সূর্যের আলোটা ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছি না। তাই চিকিৎসক থেকে শুরু করে যাঁরা এ রকম চাকরি করেন, তাঁদের ভিটামিন ডি’র ঘাটতি দেখা দেয়।
ভিটামিন ডি’র রোগীগুলো আমরা সাধারণত পেয়ে থাকি এমন যে, তাঁরা একটু অবসন্ন থাকেন। শক্তি পায় না, উঠতে-বসতে গেলে অসুবিধা হয়, মস্তিষ্ক ভালো কাজ করছে না, গেরোতে গেরোতে ব্যথা হয়। বাচ্চাদের এবং বয়স্কদের জন্য এটি বড় সমস্যা। তবে তরুণ যাঁরা রয়েছে, তাদের এভাবে (গেরোতে ব্যথা) সমস্যাটি প্রকাশ পায়। তাদের সাধারণত ভিটামিন ডি’র পরীক্ষাটি করাতে হয়। এই পরীক্ষা এখন বিভিন্ন হাসপাতালে করা হয়। সেটা দেখে আমরা রোগ নির্ণয় করি। এটার আবার কিছু পর্যায় রয়েছে। একটি হলো ইনসাফিসিয়েন্সি (অপ্রতুলতা) এবং রিয়েল ডেফিসিয়ন্সি (আসল ঘাটতি)। আমরা সাধারণত বলে থাকি ১০ ন্যানোগ্রামের যদি নিচে থাকে এটা রিয়েল ডেফিসিয়েন্সি। আর ১০ থেকে ৩০ হলো ইনসাফিসিয়েন্সি। অপ্রতুলতা আগে থেকে ধরা পড়লেও এগুলোর সুন্দরভাবে চিকিৎসা করতে পারি।
প্রশ্ন : প্রবীণদের ক্ষেত্রে দেখা যায় সাধারণত চিকিৎসকরা ভিটামিন ডি চিকিৎসাপত্রে দিয়ে থাকেন। এর কারণ কী, তাঁদের কি ঘাটতি বেশি?
উত্তর : ভিটামিন ডি বয়স্ক লোকদের জন্য একটু বেশি প্রয়োজন হয় তরুণদের তুলনায়। এর কারণ দেখা গেছে যে তাঁদের যে পেশির শক্তিগুলো বয়সভেদে কমে যায়। ভিটামিন ডি দেওয়া গেলে এই সমস্যাগুলোর কম হয় এবং দেখা গেছে তাঁদের মৃত্যুর হারও কম থাকে। আর এই ধরনের লোকগুলোর তো সাধারণত বাইরের কার্যক্রম বেশি থাকে না। বেশির ভাগ সময় তারা ঘরে থাকে। তো তাদের ভিটামিন ডি’র ঘাটতি হওয়া খুবই স্বাভাবিক এবং তাঁদের পরিমাণটাও একটু বেশি লাগছে।
প্রশ্ন : আপনি বলছিলেন শতকরা ৭০ থেকে ৮০ ভাগ ভিটামিন ডি’র উৎস হলো সূর্যের আলো। সকালবেলার কোন সময়টায় সূর্যের আলো কাছাকাছি থাকা উচিত?
উত্তর : ভিটামিন ডি’র ঘাটতি বেশি হয় শীতকালে। গরমকালে সাধারণত এতটা হয় না। সাতটা থেকে শুরু করে ১২টা পর্যন্ত যদি মুখ, ঘাড় এবং হাতে সূর্যের আলো ২০ মিনিটের ওপরে পড়ে তাহলে হয়। তবে এটা একটু গায়ের রং ভেদে। যাঁরা একটু ফর্সা, তাঁদের সপ্তাহে দুবার ২০ মিনিট করে নিলেই পর্যাপ্ত হবে। যাঁরা একটু কালো, তাঁদের ৩০ মিনিট আলোর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন, সপ্তাহে দুদিন। ফটো অক্সিডেশনটা সাধারণত শুরু হয় ১৫ মিনিট থেকে। তাই যদি ১০ মিনিট রোদ লাগিয়ে চলে আসেন তাহলে কাজ হবে না। যখন প্রক্রিয়াটি শুরু হয় তখন খুব দ্রুত ডি তৈরি হয়।
প্রশ্ন : কেউ যদি ভিটামিন ডি’র এই ঘাটতি পূরণের জন্য ভিটামিন ডি সাপ্লিমেন্ট নিতে থাকে, দীর্ঘদিন ধরে হয়তো খাচ্ছেন; তাতে কি তাঁর অতিরিক্ত ভিটামিনজনিত কোনো সমস্যা হতে পারে কি?
উত্তর : এটি আরেকটি মারাত্মক সমস্যা। এটি নিয়ে তো কথাবার্তা হচ্ছে। আসলে আপনাকে জানতে হবে রিপ্লেসমেন্টটা (বদলি) প্রয়োজন কি না। এটাও কতটুকু দিতে হবে। তবে আপনি যদি অযাচিতভাবে খেতে থাকেন তখন হাইপার ভিটামিনোসিস হবে। এটি হলে ক্যালসিয়াম রক্তের মধ্যে বেশি হবে। এটি হলে কিডনিতে পাথর হওয়া থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকমের টক্সিসিটি করতে পারে। বমি, কিডনিতে পাথর, পেপটিক আলসার এ রকম অনেক সমস্যা হবে। তাই এই বিষয়ে সচেতন হতে হবে। ভিটামিন ডি’র চিকিৎসা করেন, মোটামুটি অভিজ্ঞ, সে রকম চিকিৎসকের কাছ থেকে চিকিৎসা নিতে হবে।
প্রশ্ন : আমরা দেখি অনেক মানুষই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই ভিটামিন ডি এবং ক্যালসিয়াম খেতে থাকেন। এই বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?
উত্তর : আসলে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এটা করা উচিত নয়। দেখুন ক্যালসিয়ামের প্রধান উৎস হলো দুগ্ধজাতীয় খাদ্য। তবে হয়তো দুগ্ধজাতীয় খাবার অনেকেরই সাধ্যে হয় না। তাই আমাদের দেশে ক্যালসিয়ামের ঘাটতির একটি বিষয় রয়েছে। যাঁরা দুধ খান না তাঁদের জন্য ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নেওয়া যেতে পারে। তবে মেনোপজের পর যদি দুধ না খেয়ে থাকেন, তখন একটি করে ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট নিলে কোনো অসুবিধা নেই। আর দুধ খেলে তো ঠিকই আছে। তবে সাপ্লিমেন্ট অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী নেওয়া উচিত। ক্যালসিয়াম শরীরে প্রয়োজন ৭০০ থেকে ৮০০ মিলিগ্রাম দৈনিক। ক্যালসিয়াম ট্যাবলেট যেগুলো আমাদের দেশে পাওয়া যায় সেটি ৫০০ মিলিগ্রাম । সুতরাং বেশি ডোজ হওয়ার আশঙ্কা নেই। তবে চিকিৎসকই আপনার বিষয়ে মতামত দেবেন। নিজে নিজে সাপ্লিমেন্ট না নেওয়াই ভালো।