চোখে ছানি পড়লে

সাধারণত বৃদ্ধ বয়সে চোখের ছানি পড়ে। তবে কিছু কিছু ছানির ক্ষেত্রে প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। আজ ১৭ নভেম্বর এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২২০৮তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. বজলুল বারী।
প্রশ্ন : একজন মানুষের চোখে ছানি পড়ে কেন এবং কারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?
উত্তর : চোখের ছানি, চোখের রোগের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রতীয়মান সংখ্যার দিক থেকে। সবচেয়ে বেশি ছানি পড়ে বয়সের কারণে। অর্থাৎ বয়জ্যেষ্ঠ যাঁরা, তাঁরা সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হন এ রোগে। আর যাঁদের ডায়াবেটিস থাকে বা অন্যান্য রোগবালাই বেশি থাকে, স্টেরয়েড-জাতীয় ওষুধ খান, তাদের ক্ষেত্রে ছানিটা তাড়াতাড়ি আসে এবং বেশি পরিমাণ পড়ে। মাতৃগর্ভে থাকা অবস্থায় মায়ের কিছু রোগ আছে যেগুলো বাচ্চাকে সংক্রমিত করে। সেসব ক্ষেত্রেও বাচ্চাদের জন্মগতভাবে ছানি থাকতে পারে।
প্রশ্ন : একজন মানুষের চোখে ছানি পড়লে কী ঘটে? কী সমস্যা হয়?
উত্তর : ছানি সাধারণত ধীরে ধীরে আসে। চোখের প্রধান কাজ হচ্ছে দৃষ্টি। এই দৃষ্টিটা একপর্যায়ে ঘোলা হয়ে আসে এবং সম্পূর্ণ রূপে চলে যায়। সাধারণত দুই চোখের মধ্যে যদি এক চোখে ছানি আসে, আর আরেক চোখে না আসে, তখন রোগীরা বুঝতেই পারেন না তাঁর এক চোখে ছানি আছে। দৃষ্টিকে ছানি আস্তে আস্তে ঘোলা করে এবং একপর্যায়ে নষ্ট করে দেয়।urgentPhoto
প্রশ্ন : ছানিতে সাধারণত চোখের কোন অংশে কী ঘটে?
উত্তর : চোখের মধ্যে একটি স্বচ্ছ অংশ রয়েছে, যাকে আমরা বলি লেন্স। ক্যামেরার লেন্সের মতো। ঠিক ক্যামেরা যেই কাজটি করে লেন্সও একই কাজ করে। কোনো একটা জিনিসের প্রতিবিম্বটা লেন্সের মতো করে রেটিনার ওপর ফেলে এবং এরপর রেটিনা একে মস্তিষ্কের মধ্যে পাঠায়। তখন আমরা দেখতে পাই। লেন্স যদি ঘোলা হয়ে যায়, অর্থাৎ এর স্বচ্ছতা নষ্ট হয়ে যায়, তখন আমরা তাকে বলি ছানি।
প্রশ্ন : একজন মানুষের চোখে ছানি পড়লে সেটি দেখতে কেমন হয়?
উত্তর : আমরা ছবিটা লক্ষ করলে দেখব চোখের মণির মাঝখানে, আমরা সাদা একটা অংশ দেখতে পাচ্ছি। এই সাদা অংশটাই যেটা দেখা যাচ্ছে, যার চারপাশে কালো দাগ, মাঝখানে সাদা এটিই হচ্ছে ছানি। এটা চোখের দুই থেকে তিন স্তর ভেতরের একটি অংশ। এখানে মণিকে আমরা বড় করেছি বলে বিষয়টি অনেক বেশি পরিমাণ দেখা যাচ্ছে। তা ছাড়া ছোট করেও দেখা যায়। গ্রামাঞ্চলে চোখের মণিকে চোখের রাজা বলা হয়। এর মধ্যে সাদা অংশ দেখা গেলে গ্রামের মানুষও বুঝতে পারে যে চোখের মধ্যে পর্দা পড়েছে বা ছানি পড়েছে।
প্রশ্ন : আগে থেকে সতর্ক হলে কি ছানি রোগকে প্রতিরোধ করা যায়?
উত্তর : কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা ছানি প্রতিরোধ করতে পারি। যেমন যাদের অল্প বয়সে ডায়াবেটিস হয়, তাদের রোগটি যদি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে ছানি হয়তো তার অল্প বয়সে বা কম বয়সে পড়বে না। দীর্ঘজীবন সে ছানি ছাড়া বাঁচতে পারবে।
আর সবচেয়ে বেশি যে ছানি পড়ার কারণ সেটি হলো বয়স। বয়স তো আমরা থামিয়ে রাখতে পারি না। বয়সের কারণে যে ছানি পড়ে একে আমরা প্রতিরোধ করতে পারব না। তবে অন্যান্য কারণে যে ছানি পড়ে, একে আমরা প্রতিরোধ করতে পারি।
প্রশ্ন : বয়সজনিত কারণে ছানি পড়ে। তো ছানি হলেই কি চোখে অস্ত্রোপচার (অপারেশন) করতে হয়?
উত্তর : ছানি পড়লেই যে অস্ত্রোপচার করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। অর্থাৎ ছানি পড়ার পরে আমরা প্রথমে চশমা দিয়ে দেখি, এই মানুষটি তার যে দৈনন্দিন কার্যক্রম আসে সেটি চালিয়ে যেতে পারছেন কি না। যদি চশমা দিয়ে চালিয়ে দেওয়া যায় তাহলে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন নেই। যতদিন চশমা দিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে, জীবন যাপন চলবে, ততদিন পর্যন্ত ছানির অস্ত্রোপচারের কোনো প্রয়োজন নেই। তবে যদি মনে হয় ছানি অল্প, তবে তার দৃষ্টি সমস্যা করছে, সে তার চাকরির ক্ষেত্রে, দৈনন্দিন জীবনে কার্যক্রমে অসুবিধায় পড়ছে তখন আমরা বলি ঠিক আছে ছানি অস্ত্রোপচার করে নিন।
আর ছানির আধুনিক পদ্ধতি হচ্ছে একেবারেই অল্প পরিমাণ অংশ কেটে বা ছিদ্র করে অস্ত্রোপচার করা হয়। মনে করেন, এটি দুই থেকে আড়াই মিলিমিটার, এটা করে আমরা লেন্সকে গলিয়ে বের করে নিয়ে এসে ওখানে একটা স্বচ্ছ লেন্স প্রতিস্থাপন করে দিই। যেটাকে আমরা ইন্ট্রাভোলার লেন্স বলি। অর্থাৎ ফেকো সার্জারি করে আমরা ছানি এবং ওখানে একটা স্বচ্ছ জিনিস ওই মাপের বসিয়ে দিই। এবং আজকাল ছানির এত আধুনিক পদ্ধতি বাংলাদেশে তাহলে এ মানুষ একদিন পরই স্বচ্ছভাবে দেখতে পারে। আজকাল ছানির এত আধুনিক পদ্ধতি বাংলাদেশে এসেছে এবং চক্ষু চিকিৎসার ক্ষেত্রে আমরা অহংকারের সঙ্গে বলতে পারি পৃথিবী থেকে একেবারেই পিছিয়ে নেই। বরং কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমরা এগিয়ে আছি।
প্রশ্ন : ছবির মাধ্যমে যদি একটু দেখিয়ে বলেন আধুনিক সেই পদ্ধতি কীভাবে করছেন?
উত্তর : এই ছবিতে ছানিকে আস্তে আস্তে একটি ছোট্ট শলাকার মতো জিনিস দিয়ে ভেঙে ফেলা হচ্ছে এবং একে গলিয়ে বের করে ফেলা হচ্ছে। এরপর একটা পর্যায়ে দেখা যাবে এটা পরিষ্কার করে আমরা এই জায়গার মধ্যে একটা স্বচ্ছ লেন্স প্রতিস্থাপন করব। এটা একধরনের আলট্রাসাউন্ড যেটা পেটের ক্ষেত্রে বা ইকোকার্ডিওগ্রামের ক্ষেত্রে সেটা দিয়ে করা হয়।
এটি করার ফলে একটু আগে ঘোলা ছিল এখন জায়গাটা স্বচ্ছ পরিষ্কার হয়ে গেল। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা এখানে একটি স্বচ্ছ লেন্স বসিয়ে দেব। ছবিতে লেন্স দেখা যাচ্ছে। বড়জোর দুই মিলিমিটার ছিদ্র করে এর মধ্য দিয়ে এত বড় একটি কাজ করে ফেলা হলো। এবং এই মানুষটি যদি ইচ্ছা করেন আজ দুপুর বেলা অস্ত্রোপচার হয়েছে, রাত্রিবেলা উনি টেলিভিশন দেখতে চান তাও করতে পারবেন। এই অপারেশনে অজ্ঞান করার প্রয়োজন নেই। রক্তপাতের বিষয় নেই। অজ্ঞান করার তো প্রয়োজন হয়ই না, জায়গাটার মধ্যে যে ইনজেকশন দিয়ে এনেসথেসিয়া দেব তাও প্রয়োজন হয় না। শুধু একটু ড্রপের মাধ্যমে জায়গাটাকে একটু অবশ করছি এবং রোগী তার চোখ নাড়াচ্ছেন। আমরা গল্প করছি, কথা বলছি। এর মধ্যেই অস্ত্রোপচার হয়ে যাচ্ছে।
প্রশ্ন : একজন মানুষের যদি দুই চোখেই ছানি থাকে, দুই চোখ কি একসঙ্গে অস্ত্রোপচার করা যায়? না কি আগে-পরে করতে হয়?
উত্তর : আসলে যখন চোখের অস্ত্রোপচার আমরা করি, সেটি শুধু চোখের অস্ত্রোপচার নয়। এর সঙ্গে তাঁর মনোজগতে একটি বিশাল যোগাযোগ রয়েছে। তাঁর প্রেসারের যোগাযোগ থাকে, মস্তিষ্কের, হার্টের সরাসরি যোগাযোগ থাকে। কাজেই আমরা যদি একসঙ্গে করতে যাই, রোগীর ওপর মানসিক চাপ অনেক বেশি থাকে। এতে অনেক জটিলতা তৈরি হতে পারে।
আর কোনো কারণে যদি জিনিসপত্রের মধ্যে কোনো ত্রুটি থাকে, যেমন অনেক জিনিসপত্র আমাদের কোম্পানির কাছ থেকে নিয়ে ব্যবহার করতে হয়, যদি কোনো ইনফেকশন হয়, তখন দুটো চোখ একসঙ্গে চলে যাবে। সে জন্য এটা একসঙ্গে কখনোই করা যাবে না এবং করা যায় না।
প্রশ্ন : কেমন বিরতি দিয়ে করেন?
উত্তর : একটা চোখ করার পরে জিজ্ঞেস করি আপনি কী মনে করেন। রোগীর সাহস দেখি, তাঁর প্রস্তুতি দেখি। মানসিক অবস্থা দেখি। যদি রোগী বলেন, ডাক্তার সাহেব আমি পরে করব। আমরা বলি ঠিক আছে পরে করেন। আর রোগী যদি বলে, আমি এক সপ্তাহ বা ১৫ দিন পরে করব আমরা সেটাও করে দিতে পারি।