কোরবানির ঈদ
‘পরিমিত খেতে হবে’

কোরবানির ঈদ চলে এসেছে। কোরবানির ঈদ মানেই নানা ধরনের খাবার, আনন্দ। সেই আনন্দের মাঝে যেন স্বাস্থ্য সুরক্ষা করা যায়, সেটি নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা। আজ ২৪ সেপ্টেম্বর, স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১৬১তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড বারডেম হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক ডা. খাজা নাজিমুদ্দিন।
প্রশ্ন : কোরবানির ঈদে স্বাস্থ্য সুরক্ষায় কোন কোন বিষয়ে সচেতন হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : উৎসব মানেই তো ভিন্ন বিষয়। খাওয়া-দাওয়া ভিন্ন, পরিবেশ ভিন্ন, কাজকর্ম ভিন্ন। সবার জন্য তো এই বিষয় আর ঝামেলা নয়। সবাই তো আর রোগী নয়। তবে যাঁরা ভালো মানুষ, তাঁদের জন্যও খাবারে সীমাবদ্ধতা আছে। আমাদের হিসাব করে পরিমিত খেতে হবে। আপনি তিন দিন সারা বছরের সব খাবার খেয়ে নিলেন, তা তো নয়।
কোরবানি ঈদ হলো বিশেষ উৎসব। রোজা ও কোরবানির ঈদের পার্থক্য হলো, এখানে মাংস বিভিন্ন ধরনের হয়। মিষ্টি বা অন্যান্য খাবার সবই খাওয়া হয়। তবে বিশেষ করে মাংস খাওয়া হয়। গরুর মাংস, খাসির মাংস, যেগুলোকে আমরা বলি লাল মাংস এবং চর্বিযুক্ত মাংস—এগুলো বেশি খাওয়া হয়। এটা অতিরিক্ত খাওয়া স্বাস্থ্যের জন্য ভালো নয়। আবার উল্টো বিষয়ও আছে। শরীরের সব কোষেই চর্বি রয়েছে। এই চর্বি খাবার থেকে আসে। তাই আবার খেতেও হবে। তবে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থেকে খেতে হবে।
এখন পরিসংখ্যান যদি ১০ শতাংশ লোকের ডায়াবেটিস হয়, ২০ শতাংশ লোকের উচ্চ রক্তচাপ হয়, আরো কিছু লোকের কোলেস্টেরল বেশি রয়েছে—এই লোকদের জন্য প্রতিরোধ অবশ্যই দরকার। তবে যাঁদের এগুলো নেই, তাঁদের নিষেধ করা হলে বেশি বলা হয়। তবুও অতিরিক্ত কিছুই ভালো নয়। আপনি যদি কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ খাবার বেশি খান, প্যানক্রিয়াটাইটিস হতে পারে। এমনকি কোলেস্টেরল শরীরে না থাকলেও এই সমস্যা হতে পারে।
প্রশ্ন : তাহলে এ সময়ে খাবারের ভারসাম্য রক্ষার্থে কী করা যেতে পারে?
উত্তর : এখন স্বাভাবিক খাবারের যে বিষয় রয়েছে, এতে ৫০ শতাংশ প্রোটিন, ২০ থেকে ৩০ শতাংশ চর্বি, বাকি কার্বোহাইড্রেট—এটা হলো খাওয়ার নিয়ম।
এখন অন্যভাবে বলি, যাঁরা গ্রামে থাকেন, আমরা যাঁরা আগে গ্রামে ছিলাম, আমাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা যাঁরা রয়েছেন—তাঁরা এই হিসাব করে খেতেন না। তবে তাঁদের অসুখ তো কম ছিল বলা হয়। কারণ, তাঁদের কায়িক পরিশ্রম বেশি ছিল।
এখন ঈদের দিনের জন্য এটাই বলব যে যাঁদের ডায়াবেটিস রয়েছে, যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ রয়েছে, যাঁদের কোলেস্টেরল আছে, তাঁরা যেন চিকিৎসকের নিষেধগুলো মনে রাখেন। যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ এবং হার্টের সমস্যা রয়েছে, যাঁদের ডায়াবেটিসের জন্য কিডনির অসুখ রয়েছে, তাঁদের জন্য খাবারে সীমাবদ্ধতা রয়েছে।
প্রশ্ন : একদিনের বা দুদিনের এই খাবারটি তার জন্য অনেক ঝুঁকি...
উত্তর : বিরাট ঝুঁকি, কেবল ঝুঁকি নয়। কোনো কিছু খেতে নিষেধ নেই। আপনি খাওয়া বাদ দেবেন না। তবে বেশিও খাবেন না। এটুকু মনে রাখতে হবে। আপনার হয়তো কোলেস্টেরল বেশি আছে, গরুর মাংস কম খান। চর্বি ফেলে দিয়ে মাংস রান্না করে খান।
প্রশ্ন : কোরবানি ঈদে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার বিষয়ে পরামর্শ কী আপনার?
উত্তর : পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়টি খুব জরুরি। কারণ, নিরাময় থেকে প্রতিরোধ ভালো। আপনার বর্জ্য পরিষ্কার করা আপনার দায়িত্ব। এগুলো পরিষ্কার না করলে সমস্যা আপনার হবে। যাঁর হাঁপানি আছে, সেটা বেড়ে যাবে। যাঁর শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম রয়েছে, তাঁর নিউমোনিয়া হয়ে যাবে। ত্বকের সমস্যা হয়ে যেতে পারে।
প্রশ্ন : যাত্রাপথের বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইব? অনেকে গ্রামের বাড়ি যাচ্ছেন, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, তাঁদের সতর্ক থাকার উপায়গুলো কী?urgentPhoto
উত্তর : কিছু বিষয় আপনি এড়িয়ে যেতে পারবেন না। যেমন ভিড়, যানজট। এগুলোর জন্য কিছু লোকের সমস্যা হয়। বিশেষ করে যাঁদের শ্বাসতন্ত্রে সমস্যা রয়েছে, তাঁদের। যাঁর হাঁপানি থাকে, তাঁকে ইনহেলার নিয়েই যেতে হবে। এটা নিতে যেন সে না ভুলে যায়। মন্টিলুকাস জাতীয় ওষুধ যদি খায়, সেটা নিতে যেন না ভুলে। শ্বাসকষ্ট বেশি হলে তার কী কী করা লাগবে, সেটা আগে থেকে জানতে হবে। খাবার-দাবার এবং পানি খাওয়ার বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। একটু সতর্ক থাকলে সমস্যা রোধ করা যায়।
প্রশ্ন : অনেকের ক্ষেত্রে মোশন সিকনেস বা বমি হয়। সে ক্ষেত্রে..
উত্তর : অনেকের এ সমস্যা থাকে। এ ক্ষেত্রে আগে থেকে ওষুধ খেয়ে নিতে হবে। আগের রাতে খেয়ে নিতে পারে। আর যাঁদের এই সমস্যা রয়েছে, তাঁদের আরেকজনকে বিরক্ত করার চেয়ে নিজে প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিলে ভালো।
প্রশ্ন : অনেক সময় শিশুরা গ্রামে গিয়ে সাঁতার না জানার কারণে পানিতে ডুবে যেতে পারে। এ ব্যাপারে কী সতর্কতা নেবে?
উত্তর : দেখুন, পানিতে ডুবে মরে যাওয়ার হার অনেক। তাই এই বিষয়ে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ যাঁরা শহরে মানুষ, তাঁরা অধিকাংশই সাঁতার জানেন না। তাই বাচ্চাদের জন্য সাঁতার জানা জরুরি।
আরেকটি বিষয় হলো, গ্রামে গিয়ে পানি খাবেন, টিউবওয়েলের পানি নিরাপদ। তবে যে গ্লাস বা পাত্রে সরবরাহ করা হয়, সেটা যেন পরিষ্কার থাকে। আর্সেনিক আছে কি না পানিতে, সেটি দেখেও খেতে হবে।
প্রশ্ন : যাত্রাপথের একটি বিষয় জানতে চাইছিলাম। যাঁরা ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত, তাঁদের হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা থাকে। সে ক্ষেত্রে তাঁদের যাতে ওই সমস্যা না হয় কী করণীয়?
উত্তর : একটা বিষয় হলো, যাঁর ডায়াবেটিসের ওষুধ খেতে হয় না, তাঁর হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয় না। তাই তাঁর জন্য সমস্যা নেই। আর যে ওষুধ খায়, তার বেলা সাড়ে ১১টা থেকে দেড়টার মধ্যে হাইপোগ্লাইসেমিয়া বেশি হয়। তাই সে সময় ক্ষুধা লাগুক বা না লাগুক, খেয়ে নিতে হবে। আর চকলেট, গ্লুকোজ বা মিষ্টিজাতীয় জিনিস সঙ্গে রাখতে হবে।
হাইপোগ্লাইসেমিয়া হলে কী হয়? ক্ষুধা লাগবে খুব। মনে হবে দুনিয়া খেয়ে ফেলি। গা ঘামবে, কাঁপবে এর পর অজ্ঞান হয়ে পড়বে। তাই এ রকম লাগলে আগেই খেয়ে নিতে হবে।
আরেকটি হাইপোগ্লাইসেমিয়া হয় রাতে। তিনটা-চারটার দিকে সব মানুষের রক্তে সুগার কম থাকে। সে সময় ডায়াবেটিস রোগেও সুগার কমে যায়। এর প্রতিরোধে রাতে শোয়ার সময় কিছু খেয়ে নিতে হবে। বিশেষ করে যাঁরা ইনসুলিন নেন, তাঁরা রাত ১১টার সময় নেবে। আর যদি হয়ে যায়, তাহলে ডোজ কম নিতে হবে।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে অজ্ঞান পার্টির একটি খারাপ প্রভাব রয়েছে। এ রকম সমস্যার মুখোমুখি হলে কী করণীয়?
উত্তর : আমাদের দেশে অজ্ঞান হতে ডায়জিপাম গ্রুপের ওষুধ দেয়। একটা নয়, দুটো ওষুধ দেওয়া হয় ডায়াজিপাম এবং মরফিন গ্রুপের ওষুধ। এগুলো হার্টের ওপর কোনো প্রভাব ফেলে না। প্রভাব ফেলে শ্বাসতন্ত্রের ওপর। যেটাই হোক, নিকটস্থ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। আর এ ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে নিজেদেরও সতর্ক থাকতে হবে।