কোলোরেক্টাল ক্যানসার কেন হয়?

কোলোরেক্টাল ক্যানসার বেশ প্রচলিত রোগ এখনকার সময়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে এর চিকিৎসা নিলে রোগটি সম্পূর্ণ নিরাময় করা সম্ভব। আজ ৬ জুলাই এনটিভির স্বাস্থ্য প্রতিদিন অনুষ্ঠানের ২১১২তম পর্বে এ বিষয়ে কথা বলেছেন জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের কোলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. এস এম এ এরফান।
প্রশ্ন : কোলোরেক্টাল ক্যানসার আসলে কী, শুরুতে এই বিষয়টি জানতে চাই?
উত্তর : কোলোরেক্টাল ক্যানসার বিষয়টি তো মোটামুটি সবাই বোঝে। কোলোন হচ্ছে অন্ত্র, আমাদের খাদ্য পরিপাক এবং খাদ্যের যে নালিটি রয়েছে সেটার নিচের যে অংশ রয়েছে একে বলা হয় কোলন বা বৃহদন্ত্র। আর তারও নিচের যেই অংশটা যেখানে মলটা জমা থাকে বাউয়েল মুভ করার আগে সেটাকে বলা হয় রেক্টাম। এই অংশের ক্যানসারকে বলা হয় কোলোরেক্টাল ক্যানসার। এই কোলোরেক্টাল ক্যানসার প্রচলিত একটি রোগ।
প্রশ্ন : বাংলাদেশে এর অবস্থাটা কেমন?
উত্তর : পৃথিবীতে কোলোরেক্টাল ক্যানসার দ্বিতীয় প্রচলিত ক্যানসার। পুরুষদের ক্ষেত্রে ফুসফুসের ক্যানসারের পরে কোলোরেক্টাল ক্যানসার। আর নারীর ক্ষেত্রে স্তন ক্যানসারের পরেই কোলোরেক্টাল ক্যানসার। বাংলাদেশেও এর প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। তবে আগে রোগনির্ণয় করা হতো না বলে হয়তো বোঝা যায় না। এখন আমরা এর অনেক রোগী পাচ্ছি। এর প্রাদুর্ভাবও অত্যন্ত দ্রুতগতিতে বাড়ছে। হয়তো আগে রোগনির্ণয় হতো না বলে আমরা জানতাম না। তবে এখন এর অনেক রোগী পাচ্ছি এবং এর প্রাদুর্ভাবও পাশ্চাত্যের কাছাকাছি বলতে হবে।
প্রশ্ন : এই রোগ কেন এত বেড়ে যাচ্ছে?
উত্তর : এর বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। একটি কারণ, প্রি ক্যানসারাস অবস্থা হচ্ছে কোলন পলিপ। এই পলিপগুলো বাংলাদেশ খুব বেশি ডায়াগোনোসিস হচ্ছে না। না হওয়ার ফলে এটা দীর্ঘদিন থেকে যায় এবং শেষ পর্যন্ত এটা ক্যানসারের রূপান্তরিত হয়। দুঃখজনক বিষয় হলো, এই পর্যায়ের ক্যানসারটা খুব তরুণ বয়সে হয়। অর্থাৎ ৩০ থেকে ৩৫ বছরের লোকজনের মধ্যে এই ক্যানসার বেশি হতে দেখা যায়। এ জন্য আমরা এই বয়সের ক্যানসার রোগী অনেক পাচ্ছি। এটা খুব খারাপ বিষয়। আরেকটি কোলন ক্যানসার হওয়ার কারণ হচ্ছে খাবারদাবার। যেসব এলাকা বা যেসব মানুষ রিচ ফুড খান, চর্বিজাতীয়, উচ্চ প্রোটিন-জাতীয় খাবার খাচ্ছেন এবং আঁশ-জাতীয় খাবার যখন কম খাচ্ছেন, তাঁদের এই ক্যানসারটা অনেক বেশি হচ্ছে। আমাদের দেশেও এই ক্যানসার বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে এটা আবার প্রবীণ বয়সে বেশি হয়। ৫০-এর ওপরে লোকদের ডায়াটারি সম্পর্কিত ক্যানসার হয়।
প্রশ্ন : কী কী ধরনের লক্ষণ প্রকাশ পায় ক্যানসারে?
উত্তর : যেকোনো ক্যানসারের প্রাথমিক পর্যায়ে খুব বেশি লক্ষণ দেখা যায় না। পলিপের ক্ষেত্রে যেটা হতে পারে সেটা হচ্ছে মলের সঙ্গে রক্ত যেতে পারে। এখানে আমাদের দেশের রোগীরা এবং অনেক চিকিৎসকও এটা মনে করেন যে তার পাইলস হয়েছে। পাইলস মনে করে বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা করেন তবে শেষ পর্যন্ত দেখা যায় এটা রেক্টাল পলিপ। পলিপটা থেকে যায় মাঝে মাঝে রক্ত যায় বা মাঝে মাঝে যায় না। তবে সেটা থেকে যাওয়ার কারণে ক্যানসার হিসেবে রূপ নেয়।
প্রশ্ন : এই ভুল রোগ নির্ণয়টি কেন হচ্ছে?
উত্তর : এটা আসলে সচেতনতার অভাব। একজন রোগী হয়তো, নারী হলে গাইনোকোলজিস্টের কাছে যাচ্ছেন বা মেডিসিনের চিকিৎসকের কাছে যাচ্ছেন। যার ফলে তারা তো আর সেটা পরীক্ষা করে দেখছেন না। এর কারণে এটা হয়।
আবার এমনকি কোলন পলিপ হয়েছে সেই পলিপটা সরিয়ে ফেলা হয়েছে তারও কিন্তু কোলন ক্যানসার হচ্ছে। আসলে নিয়মিত ফলোআপ করতে হবে এবং কোলোনস্কোপি করতে হবে। অন্তত পাঁচ ব্ছর পরপর করতে হবে। যার একবার পলিপ হয়েছে, তার একটা প্রবণতা থাকে ওই পলিপ আবার হওয়ার। অনেকের জন্মগতভাবে, জিনগতভাবে পলিপ হওয়ার প্রবণতা থাকে। এই পলিপ ক্যানসারে পরিবর্তন হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সুতরাং যার একবার হয়েছে তার প্রতি উপদেশ থাকবে তিনি যেন পাঁচ থেকে সাত বছর পরপর একবার কোলোনোস্কোপি করেন। তাহলে খুব প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়বে এবং চিকিৎসা অনেক সহজ হবে।
প্রশ্ন : যখন প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ে, তখন চিকিৎসায় আপনারা কী দিয়ে থাকেন?
উত্তর : পলিপটা আমরা পলিটেক্টোমি করি কোলোনস্কোপির মাধ্যমে। সেটা হিস্টোপেথোলজিও করা হবে। সেখানে যদি ক্যানসারাস কোনো কিছু পাওয়া না যায় এটার ফলোআপ করবে। যদি ক্যানসারের কোনো জিনিস পাওয়া যায় তখন এই ক্যানসারের চিকিৎসা অন্য ক্যানসার থেকে অনেক সহজ। কেবল ওই অংশটা অস্ত্রোপচার করে ফেলে দিতে হবে। এটা অনেক বড় একটা অংশ। তবে পুরো অংশটাই ফেলে দিলে কোনো সমস্যা হবে না। এই ক্ষেত্রে কোলনের অংশটা ফেলে দিয়ে আবার জোড়া লাগিয়ে দিলে একদম স্বাভাবিক মানুষের মতো তিনি জীবনযাপন করবেন। যদি ক্যানসারটা ছড়িয়ে না যায়।
আর যদি ক্যানসার ছড়িয়ে যায়, তখন স্বাভাবিকভাবেই এর চিকিৎসা অনেক অনেক জটিল। সে ক্ষেত্রে রেডিওথেরাপি, কেমোথেরাপি দেওয়ার প্রক্রিয়া আছে। তবে সুস্থ হওয়ার হার আসলে বেশি বলা যাবে না।
প্রশ্ন : আসলে বুদ্ধির কাজ হচ্ছে শুরুতে এই ধরনের সমস্যা হলে চিকিৎসকের কাছে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া...
উত্তর : আসলেই। ভালো হওয়ার হার বেশি হবে সচেতনতা এবং রোগটি নির্ণয়ের ওপর। উন্নত দেশগুলোতে কোলোনস্কোপি স্ক্রিনিংয়ের ব্যবস্থা আছে। অর্থাৎ যাদের পলিপ তাদের নিয়মিত কোলোনস্কোপি করতেই হবে। আর ৫০-এর পর সব মানুষেরই একটা বেজ লাইন কোলোনস্কোপি করতে হবে। এবং পাঁচ থেকে সাত বছর পর কোলোনোস্কোপি তাকে নিয়মিত করতে হবে। যাতে প্রাথমিক পর্যায়ে কোলন ক্যানসার নির্ণয় করা যায়।
আর একটু বেড়ে গেলে, বিশেষ করে রেক্টাল ক্যানসারের কিছু কিছু লক্ষণ দেখা যায়। এটা আমাদের দেশের জন্য, রোগীদের জন্য বেশি প্রযোজ্য। সে ক্ষেত্রে দেখা যায় তার কোলন ক্যানসারের ক্ষেত্রে পেটে ব্যথা, বদহজম, অথবা তার মাঝে মাঝে ডায়রিয়া, মাঝে মাঝে কোষ্ঠকাঠিন্য হতে দেখা যায়। রেক্টাল ক্যানসারে তার রক্ত যেতে পারে। কোলন ক্যানসারে তার কালো পায়খানা হতে পারে। যাকে আমরা মেলেনা বলি। রেক্টাল ক্যানসারে তার সকাল বেলা একটু পাতলা পায়খানা হবে। পরে আবার পায়খানাটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কখনো পায়খানা কষা হয়ে যাবে, ঘন ঘন পায়খানা হয়। আগে তার হয়তো স্বাভাবিক পায়খানার অভ্যাস ছিল তবে এটা পরিবর্তন হয়ে যায়। এটা খুব ভীতিকর লক্ষণ। আরেকটি হচ্ছে তার পেটে চিপে চিপে ব্যথা আসে। রোগী মনে করে তার হয়তো আমাশয় হয়েছে। এটাকে আমাশয় না মনে করে পুরোপুরি চেকআপ করা জরুরি। কারণ আমরা এ রকম অনেক রোগী পেয়েছি যারা এরকম লক্ষণ নিয়ে দীর্ঘদিন রয়েছে মনে করেছে তার আমাশয়। যখন এসেছে তখন দেখা গেছে অনেক বেশি হয়ে গেছে।
প্রশ্ন : তাহলে কখন একজন বিশেষজ্ঞের কাছে যাওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
উত্তর : আমি যেটা মনে করি যদি বাচ্চাদের ক্ষেত্রে মলের সঙ্গে রক্ত যায় অথবা তার বেশি বেশি ডায়রিয়া হয়। অবশ্যই একজন কোলোরেক্টাল সার্জনের পরামর্শ নেওয়া দরকার। তার কোনো কলোনিক পলিপ আছে কি না। এটা পরীক্ষা করে যদি তার না থাকে তবে ভালো। আর যদি থাকে তবে সারা জীবন ফলোআপের মধ্যে যেতে হবে। চিকিৎসা তো করাতেই হবে, সঙ্গে করে ফলোআপে রাখতে হবে। আর ৪০ বছরের পরে যদি কারো পায়খানার সঙ্গে রক্ত যায়, কালো পায়খানা হয়, আমাশয় হয়, পেটে ব্যথা হয় দীর্ঘদিন, একবার পাতলা পায়খানা আরেকবার কষা পায়খানা শেষ হয় অথবা যদি পেট চিপে চিপে ব্যথা আছে তাহলে অবশ্যই তার চেকআপ করানো উচিত। দেখতে হবে তার এই ধরনের ক্যানসার আছে কি না এবং অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, অপচিকিৎসকের কাছে যেন না যায়। এসব ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে গেলে রোগনির্ণয় করা সম্ভব এবং রোগী পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে।