করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে ভেষজ চা

দেশে প্রতিদিনই শত শত মানুষ করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হচ্ছেন। ভ্যাকসিন আবিষ্কারে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। এ সময়ের মধ্যে আমরা যা করতে পারি, তা হলো আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী করা, যাতে করোনাভাইরাস প্রতিরোধে আমাদের শরীর অ্যান্টিবডি তৈরি করতে পারে। কিন্তু কীভাবে?
আসুন, আমাদের প্রতিদিনকার জীবনে নজর দিই। আমরা অনেকেই এক কাপ গরম চায়ে চুমুক দিয়ে সকাল শুরু করি। অনেকে আবার কাজ শেষ করার পর সন্ধ্যায় চা পান করা উপভোগ করেন। কেমন হয় যদি আমরা প্রতিদিন এমন চা পান করার অভ্যাস তৈরি করি, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করবে? এটি কেবল মনকে সতেজই করে তুলবে না, বিভিন্ন ভাইরাস সংক্রমণ রোধের জন্য শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তুলবে। চলুন জেনে নিই, রোগ প্রতিরোধক কিছু ভেষজ চা সম্পর্কে—
গ্রিন টি
আপনি যদি সকাল শুরুর জন্য স্বাস্থ্যকর চায়ের সন্ধান করে থাকেন, তবে গ্রিন টি পান করুন। এটি ক্যাফেইনের একটি দুর্দান্ত উত্স, যা শক্তি সরবরাহ করতে পারে। গ্রিন টি বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও খনিজ বৈশিষ্ট্যে সমৃদ্ধ, যেমন পটাসিয়াম (কে), আয়রন (ফে), ক্যালসিয়াম (সিএ), প্রোটিন, ভিটামিন সি এবং ভিটামিন এ, যা সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয়।
এগুলো ছাড়াও গ্রিন টিতে অন্যান্য কিছু সক্রিয় পদার্থ রয়েছে, যেমন ক্যাটচিনস, পলিস্যাকারাইডস, ফ্যাটি এসিড, এসেনশিয়াল অয়েল, ফ্ল্যাভানলস, ক্লোরোফিল এবং আরো অনেক ভেষজ উপাদান। এসব উপাদানের কারণে গ্রিন টি বিভিন্ন ধরনের অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও অ্যান্টিএনজাইমেটিকে ভরপুর। অক্সিডেটিভ স্ট্রেস ও অটোইমিউন প্রতিরোধ করে গ্রিন টি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করতে পারে।
যেভাবে গ্রিন টি প্রস্তুত করবেন : দুই কাপ সমপরিমাণ পানি অন্তত ১০ মিনিট ধরে ফুটিয়ে নিন। ফুটন্ত পানিতে একটি টি ব্যাগ বা এক চা চামচ গ্রিন টি দিন এবং এবং তিন থেকে পাঁচ মিনিটের জন্য রাখুন। এরপর টি ব্যাগটি সরিয়ে ফেলুন। বাড়তি স্বাদের জন্য আপনি গ্রিন টিতে এক চামচ লেবুর রস বা এক চামচ মধু যোগ করতে পারেন।
ক্যামোমিল চা
যদি আপনি নিদ্রাহীনতায় ভুগে থাকেন, তাহলে ঘুমাতে যাওয়ার আগে প্রতি রাতে ক্যামোমিল চা পান করুন। ক্যামোমিল চা স্নায়ুগুলো শান্ত করে দুশ্চিন্তা কমাতে সাহায্য করে। এতে অ্যাপিজেনিন নামক একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা মানব মস্তিষ্কের নির্দিষ্ট কিছু রিসেপ্টরকে আবদ্ধ করে অনিদ্রা হ্রাস করে। পর্যাপ্ত ঘুমের পর মানবদেহ সাইটোকাইন নামে এক ধরনের প্রোটিন তৈরি করতে পারে, যা সংক্রমণ ও প্রদাহের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মাধ্যমে কার্যকর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে। এ ছাড়া ক্যামোমিল চা পেটব্যথা কমানো, হজমশক্তি বৃদ্ধি, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ এবং ত্বকের বিভিন্ন সমস্যাও দূর করতে পারে।
ক্যামোমিল চায়ে আরো অনেক গুণ রয়েছে। আপনি হয়তো জানেন, শ্বেত রক্তকণিকা (ডব্লিউবিসি) মানবদেহের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যখন কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা ছত্রাক রক্তে প্রবেশ করে, ডব্লিউবিসি সেই আক্রমণাত্মক কণাগুলো অনুসন্ধান এবং চিহ্নিত করে তা ধ্বংস করে দেয় ওই ভাইরাস থেকে রোগ হওয়ার আগেই। ক্যামোমিল চা আপনার দেহে শ্বেত রক্তকণিকার উৎপাদন বাড়িয়ে তুলতে পারে, যা ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া ও ছত্রাককে ধ্বংস করে। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরি করতে আপনার ডায়েটে ক্যামোমিল চা যুক্ত করতে পারেন।
যেভাবে ক্যামোমিল চা প্রস্তুত করবেন : ফুটন্ত পানিতে একটি টি ব্যাগ বা এক চা চামচ ক্যামোমিল চা মিশিয়ে নিন এবং চার মিনিট রাখুন। এরপর টি ব্যাগটি সরিয়ে ফেলুন। বাড়তি স্বাদের জন্য আপনি এক চামচ লেবুর রস বা এক চামচ মধু যোগ করতে পারেন।
হলুদ (হলদি) চা
তরকারি ও অন্যান্য খাবারে রান্নার উপাদান হিসেবে প্রয়োগ করার পাশাপাশি, প্রাকৃতিক উপায়ে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চা আকারে হলুদ খাওয়া যেতে পারে। হলুদে প্রচুর পরিমাণে কারকিউমিন (একটি বায়োঅ্যাকটিভ যৌগ) রয়েছে, যা প্রদাহবিরোধী উপাদান হিসেবে কাজ করে। কারকিউমিন আপনার শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে বিভিন্ন ভাইরাস বিশেষত, ফ্লু থেকে প্রতিরোধে সহায়তা করতে পারে। একটি শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে হলুদে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিইনফ্ল্যামেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা আপনার স্নায়ুকে প্রশান্ত করতে পারে এবং শরীরের কোষকে ভেতর থেকে নিরাময় করতে পারে। হলুদে রক্তের শর্করার মাত্রা হ্রাস করার মতো আরো অনেক সুবিধা রয়েছে, যা টাইপ-২ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে পারে। কিছু গবেষণায় দেখা যায়, হলুদ এলডিএল ‘খারাপ’ কোলেস্টেরল হ্রাস করতে পারে, যা হৃৎযন্ত্রের সুরক্ষা দিতে পারে।
যেভাবে হলুদ চা প্রস্তুত করবেন : দুই কাপ পানিতে দুই চামচ প্রাকৃতিক হলুদ মিশিয়ে নিন। এই মিশ্রণটিতে আপনি এক চামচ আদা, এক চিমটি কালো মরিচ, এক চামচ দারুচিনি, এক চিমটি লবঙ্গ এবং এক চিমটি জায়ফলের মতো কিছু মসলা দিতে পারেন। এই মিশ্রণ ১০ মিনিটের জন্য ফুটিয়ে নিন। খাওয়ার আগে স্বাদ বাড়াতে এক চামচ মধুও এতে যোগ করতে পারেন।
লেবু চা
আপনি যদি গলাব্যথা, মাথাব্যথা, শরীরে ব্যথা, নাক বন্ধ হয়ে যাওয়া ইত্যাদি ঠাণ্ডাজনিত অসুস্থতা অনুভব করেন, তাহলে এর ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে পান করার জন্য আপনি বেছে নিতে পারেন ধোঁয়া ওঠা এক কাপ লেবু চা। এটি আপনার স্বাস্থ্যব্যবস্থায় তাৎক্ষণিক স্বস্তি এনে দিতে পারে। এ ছাড়া ব্যথা ও প্রদাহ হ্রাস, রক্তচাপ হ্রাস, রক্তনালির কার্যকারিতা বৃদ্ধি, হজমশক্তি বৃদ্ধিসহ বিভিন্নভাবে সহায়তা করে লেবু চা।
আর কী আছে? সাধারণ সর্দি, ফ্লু, এইচ১এন১ (সোয়াইন) ফ্লু, সাইনাস প্রদাহ, পেট খারাপ, বমি বমি ভাব, কিডনিতে পাথর ইত্যাদি রোগের চিকিৎসাতে লেবু ব্যবহৃত হয়। সাম্প্রতিক করোনাভাইরাস মহামারি চলাকালে চিকিৎসকেরা কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য ভিটামিন-সি ডোজ প্রয়োগ করছেন, কারণ এখনো এ ভাইরাসের অনুমোদিত কোনো ভ্যাকসিন নেই। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা কোভিড-১৯ বা অন্যান্য সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে ভিটামিন-সি গ্রহণের পরামর্শ দিচ্ছেন।
যেভাবে লেবু চা প্রস্তুত করবেন : প্রথমে দুই কাপ পানি প্রায় ১০ মিনিটের জন্য ফুটিয়ে নিন। তারপর আঁচে জ্বাল দিন এবং এক চা চামচ চা পাতা যোগ করুন। চা পাতা কয়েক মিনিটের জন্য ফুটতে দিন। চা ফোটার পর দুই চামচ লেবুর রস যোগ করুন। অতিরিক্ত স্বাদের জন্য আপনার লেবু চাতে এক চামচ মধু যোগ করতে পারেন।
আদা চা
হাঁপানি, সর্দি, কাশি, বমি বমি ভাব, হতাশা ইত্যাদি বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা নিরাময়ের জন্য ওষুধ হিসেবে আদা মূল বা গুঁড়া ঐতিহ্যগতভাবেই ব্যাপক হারে প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। আদা কেবল ই.কোলি, শিগেলা ইত্যাদির মতো ব্যাকটেরিয়ার বৃদ্ধিই বন্ধ করে না, ভাইরাসের সংক্রমণও রোধ করে। আদায় একটি সক্রিয় যৌগ রয়েছে, যা মুখের ব্যাকটেরিয়া থেকে আপনাকে সুরক্ষা দিতে পারে। আদা আপনাকে ফুসফুসের রোগ, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা ইত্যাদির মতো দীর্ঘস্থায়ী রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়তা করতে পারে। আদা প্রাকৃতিকভাবে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বৈশিষ্ট্য সমৃদ্ধ হয়, যা আপনার দেহের কোষের ডিএনএ কাঠামোর ক্ষতি প্রতিরোধ করে। কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে আপনি আপনার ডায়েটে আদা চা যুক্ত করতে পারেন।
যেভাবে আদা চা প্রস্তুত করবেন : দুই কাপ পানিতে এক চা চামচ আদা গুঁড়া বা টাটকা আদা যোগ করুন। এবার ফুটন্ত পানিতে এক চা চামচ ব্ল্যাক টি মিশিয়ে দিন। মিশ্রণটি এক মিনিট ধরে ফুটিয়ে নিন। পানীয়টি স্বাস্থ্যকর করতে আপনি এক চামচ লেবুর রস অথবা এক চামচ মধু যোগ করতে পারেন।
এমন কোনো উপাদান নেই, যা কোভিড-১৯ থেকে আমাদের রক্ষা করতে জাদুকরি ওষুধ হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য আপনার নিয়মিত খাদ্যতালিকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, এমন খাবার যুক্ত করতে পারেন। এখনো আমরা পাঁচ ধরনের ভেষজ চা নিয়ে আলোচনা করেছি, যা আপনার শরীরকে সতেজ করতে পারে এবং ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য আপনার শরীরে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা শক্তিশালী করে তুলতে পারে। তবে আপনার স্বাদ এবং স্বাস্থ্যের অবস্থার ওপর নির্ভর করে রেসিপিগুলো ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। সুস্থ থাকুন।
সূত্র : ইউএনবি