‘বৈধ প্রক্রিয়া ছাড়া সংবিধান পরিবর্তন করার অধিকার কারও নেই’

‘কোনো রাজনৈতিক দলের অভিসন্ধির কাছে আমরা কোনোদিন মাথা নত করতে পারি না’— এমন মন্তব্য করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেছেন, যেকোনো একটা আইনানুগ বৈধ ও সাংবিধানিক প্রক্রিয়া ছাড়া বাংলাদেশের সংবিধান পরিবর্তন করার কোনো অধিকার আমাদের কারও নেই। তাহলে পরে এমন একটি পরিস্থিতির নজির সৃষ্টি হবে যে নজিরটা আগামী দুই বছর পরে, পাঁচ বছর পরে, বারবার কোনো না কোনো দাবির মুখে পড়বে যে এইভাবে এই প্রক্রিয়ায় আবার সংবিধান পরিবর্তন করেন।
আজ শনিবার (৪ অক্টোবর) দুপুরে এক আলোচনা সভায় জামায়াতে ইসলামীসহ কয়েকটি দলের জুলাই সনদ ও সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতি (পিআর) নিয়ে চলমান আন্দোলনের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি সদস্য এই মন্তব্য করেন।
‘রাষ্ট্র কোনো ছেলে খেলা নয়’ মন্তব্য করে সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ১৮ কোটি মানুষের ভাগ্য নিয়ে আমরা ছিনিমিনি খেলতে পারি না। এই রাষ্ট্রকে একটি নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে চলতে দিতে হবে। কোনো রাজনৈতিক দলের অভিসন্ধির কাছে আমরা কোনোদিন মাথা নত করতে পারি না। এই জনগণের স্বার্থই চূড়ান্ত, এই জনগণের অভিপ্রায় চূড়ান্ত। এই দেশের সার্বভৌম জনগণই হচ্ছে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়ার মালিক। আসুন আমরা তাদের কাছে যাই।
রাজধানীর রমনার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনের সেমিনার হলে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) ৩৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ‘গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠা, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে গণতান্ত্রিক উত্তরণে করণীয়’ শীর্ষক এই আলোচনা সভার আয়োজন করে এনডিপি।
‘সংবিধান কচু পাতার পানি নয়’
জুলাই সনদ সম্পর্কে সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা বলেছি, নির্বাচনের দিনে একই দিনে আরেকটা ব্যালেটের মাধ্যমে গণভোটের। সেই রায়টা নেওয়া যাবে যে এই সংস্কারের মধ্যে ঐক্যমত কমিশনের কাছে আমরা যারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছি সকল রাজনৈতিক দল সেই প্রতিশ্রুতির পক্ষে জনগণ আছে কিনা, সেই সনদের পক্ষে জনগণ আছে কিনা। ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বলুন।
তিনি বলেন, যদি জনগণ ‘হ্যাঁ’ বলে তাহলে সেই পার্লামেন্ট সেই নির্বাচিত সংসদের প্রত্যেকটা সংসদ সদস্য আইনানুগভাবে ম্যান্ডেটপ্রাপ্ত হবেন এই সনদ বাস্তবায়নের জন্য। তারা বাধ্য থাকবেন সেই সনদ বাস্তবায়নের জন্য। আমরা সেই প্রক্রিয়ার কথা বলেছি। কিন্তু না, তাদের কথাই মানতে হবে যে, সাংবিধানিক আদেশের মধ্যদিয়ে অবৈধভাবে এই ঘোষণা নাকি এখনই জারি করতে হবে উইথ ইমিডিয়েট এফেক্ট, আজকে থেকে কার্যকর হলো ধরে নিয়ে। সংবিধান তো কোনো কচু পাতার পানি নয় যে, যা খুশি, যেভাবে খুশি সেভাবে আমরা বলে দিলেই পরিবর্তন হবে।
বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস তুলে ধরে সালাহউদ্দিন বলেন, যখন সংবিধান ছিল না, দেশে যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে হয়েছিল, বাংলাদেশের উপরে যখন যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখনকার নির্বাচিত প্রতিনিধিরা এই ভূখন্ডের জন্য গণপরিষদ গঠন করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করেন। সেখানেই জনগণের সামনে তারা বললেন, তারা গণপরিষদ গঠন করলেন। তারাও রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রিপরিষদ গঠনের জন্য এখতিয়ার দিলেন এবং তারা জনগণের পক্ষে রাষ্ট্র পরিচালনা করলেন।
তিনি বলেন, তারা জনগণের পক্ষে সমস্ত আইন কানুন প্রেসিডেন্ট অর্ডারের মাধ্যমে জারি করলেন। সেই বৈধ প্রক্রিয়ার মধ্যদিয়েই বাংলাদেশ চলেছে। পরে সংবিধান হয়েছে। সেই সংবিধান অনুসারে নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনের পর প্রকৃত পরপরই সেই সাংবিধানিক প্রক্রিয়া রাষ্ট্র রেগুলারলি এসেছে, এখানে কোনো অনিয়ম হয়নি। এখন পর্যন্ত ১৭ বার এই রাষ্ট্রের সংবিধান পরিবর্তন হয়েছে। এমেন্ডমেন্ট হবে, আগামীতে ১৮ বার হবে।
‘জাতীয় সনদ প্রসঙ্গে’
সালাহউদ্দিন বলেন, আসুন, নতুন সংবিধান বলি বা সংশোধিত সংবিধান বলি, গণপরিষদের মাধ্যমে বলি বা জাতীয় সংসদের মাধ্যমে বলি— ঘটনা তো একই। আমরা একটা কথাই বলি যে, তাল ধপ করিয়া পড়িল নাকি পড়িয়া ধপ করিল। কথা তো একখানি। এই যে জনগণ ঐক্যমতে আসল, সেই রাজনৈতিক দলগুলো ঐক্যমতায় আসল সংবিধানের কিছু বিষয় সংশোধনের জন্য মৌলিক সংবিধান সংশোধনের জন্য, সেগুলো যেই প্রক্রিয়ায়ই গ্রহণ করা হবে সেই প্রক্রিয়াটা একটা সাংবিধানিক বৈধ এবং আইনানিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই হতে হবে— এটাই হচ্ছে আমাদের বক্তব্য।
তিনি বলেন, আমরা সেই আলোচনাতে এবং এই আলোচনা আবার ৫ তারিখে ডেকেছে। আমরা আশা করি, সাংবিধানিক অংশগুলো যেগুলো সংশোধনের জন্য সবাই একমত হয়েছে ‘উইথ সাম নোট অফ ডিসেন্ট’ সেই বিষয়গুলো একটা বৈধ আইনানুগ এবং সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় আমরা গ্রহণ করতে পারব। সেই আশাবাদ আমি এখনও ব্যক্ত করি।
‘তারা কারা?’
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, যারা আজ পিআর পিআর করছে তাদের উদ্দেশ্যে শুধু বলি, যে কয়টা রাজনৈতিক দল নিয়ে আপনারা মাঠে এ সমস্ত বক্তব্য দিচ্ছেন তারা কারা? তাদের সাথে আপনারা যে করছেন প্রকাশ করুন, তাদের ২৪ সালের ৭ জানুয়ারিতে কি ভূমিকা ছিল? আমরা জানি, আপনাদের অন্তর্ভুক্ত একটি রাজনৈতিক দল নাম নেব না। আপনারা নাম খুঁজে বের করবেন। তারা ৭ জানুয়ারির ‘আমি-ডামি’ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে, তারা আপনাদের দোসর হয় কিভাবে আন্দোলনে?
তিনি বলেন, যারা বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদী শাসনামলে বাতাস করেছে আওয়ামী লীগের সমস্ত কর্মকাণ্ডে, তারা আপনাদের আন্দোলনের শরিক হয় কিভাবে? বাংলাদেশের মানুষ তাদের মুখোশ চিনে মুখোশ উন্মোচন করেছে। আমরা মনে করি, জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য আপনাদের কোনো আন্দোলন করা সঠিক হবে না বাংলাদেশের এই গণতান্ত্রিক আবহের মধ্যে, আমরা চাই সবাই ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যে অটুট থাকুক। আমাদের সবার চাওয়া উচিত ফ্যাসিবাদ বিরোধী জাতীয় ঐক্যকে আমরা সমুন্নত রেখে এটাকে শক্তিতে পরিণত করে চিরতরের জন্য ফ্যাসিবাদী শক্তিকে নির্বাসনে দেই।
তিনি বলেন, পিআর মানে আমি অনেক সময় বলেছি, এটা পার্মানেন্ট রেস্টলেসনেস। এটা স্থায়ীভাবে অস্থিরতা সৃষ্টি করে, অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে রাষ্ট্রে। পৃথিবীর যে সমস্ত দেশে এটা এক্সপেরিমেন্ট হয়েছে সেই সমস্ত দেশের নজির আপনারা দেখুন। আপনারা খুব সম্প্রতি দেখবেন নেপালের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। সেখানেও পিআর বিদ্যমান, কখনও স্থায়ী সরকার ব্যবস্থা থাকে না, স্থিতিশীল সরকার ব্যবস্থা থাকে না। দুই মাস, ছয় মাস, পাঁচ মাস, এক বছর পরে সেই সমস্ত জায়গায় খালি প্রধানমন্ত্রী চেঞ্জ হয়, সরকার চেঞ্জ হয়, কোনো প্রত্যাশা-জনপ্রত্যাশা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না।
পিআর প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা আরও বলেন, কোনো দলের রাজনৈতিক অঙ্গীকার বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না, জনগণের কল্যাণে কোনো কিছুই বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। একটা অস্থিতিশীল অস্থির পরিবেশের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশকে আমরা যেতে দিতে চাই না। যেখানে সিম্পল মেজরিটি অথবা মেজরিটির ভিত্তিতে কোনো দল এবং জোট সরকার গঠন করতে পারে না, সেরকম একটা ব্যবস্থাকে আমরা আহ্বান জানাতে পারি না।
সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, যে সমস্ত রাজনৈতিক দল নিজস্ব রাজনৈতিক স্বার্থে জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে, দেশের স্বার্থকে জনগণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিচ্ছে হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে, তাদেরকে বলব, আপনারা বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে সঠিক রাস্তায় ফেরত আসুন। জনগণকে বিভ্রান্ত করবেন না।
তিনি বলেন, আপনারা কি জানেন পিআর পদ্ধতিতে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীর কোনো জায়গা আছে? আপনারা যে কেউ যদি কোনো নির্বাচনী এলাকার মধ্যে কেউ একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়াতে চান তার জন্য পিআর পদ্ধতিতে তো কোনো খানা নাই। তারা কি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য সাংবিধানিক অধিকার রাখে না? আমরা স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশের রাজনীতির ময়দানে এবং নির্বাচনে অস্থিরতা সৃষ্টি করার জন্য, বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বিলম্বিত করার জন্য এবং পারতপক্ষে বানচাল করার জন্য যে শক্তি কাজ তার পক্ষেই এই রাজনৈতিক দলটি কাজ করছে বলে আমাদের সন্দেহ। কারণ বাংলাদেশে যদি নির্বাচন বিলম্বিত হয় তাহলে ফ্যাসিবাদের উৎপাত হবে আবার।
এনডিপির সভাপতি আবদুল্লাহ আল হারুনের সভাপতিত্বে ও মহাসচিব জামিল আহমেদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় ন্যাশনাল পিপলস পার্টির ফরিদুজ্জামান ফরহাদ, মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা, গণ দলের এটিএম গোলাম মাওলা চৌধুরী, সাম্যবাদী দলের সৈয়দ নুরুল ইসলাম, গণঅধিকার পরিষদের রাশেদ খান, ডেমোক্রেটিক লীগের খোকন চন্দ্র দাস, জনতার অধিকার পার্টির তরিকুল ইসলাম, ন্যাপের আবদুল বারেক, এনডিপির আওলাদ হোসেন প্রমুখ বক্তব্য দেন।