নুরাল পাগলার মরদেহ পোড়ানোর ঘটনায় নিহত ১

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলায় নিজেকে ইমাম মাহদি দাবিকারী নুরাল পাগলার মরদেহ পোড়ানোর ঘটনায় একজন নিহত হয়েছেন। আজ শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) বাদজুমা গোয়ালন্দ উপজেলা আনসার ক্লাব চত্বরে এলাকার নুরাল পাগলের আস্তানায় হামলায় প্রথমে আহত হন তিনি।
নিহত ব্যক্তি উপজেলার দেবগ্রাম ইউনিয়নের পূর্ব তেনাপচা জুট মিস্ত্রিপাড়ার মো. আজাদ মেম্বারের ছেলে মো. রাসেল মোল্লা (২৮)। ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তিনি মারা গেছেন।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন মো. রাসেল মোল্লার চাচাতো ভাই জেলা ছাত্রদলনেতা শাহারিয়ার আদনান নুর ইসলাম।
এক সময় ইমাম মাহদি দাবিকারী নুরাল পাগলার মৃত্যুর পর তার কবর ভিন্নরীতিতে দেওয়া হয়। এ নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে চলছিল উত্তেজনা। আজ বাদজুমা গোয়ালন্দ উপজেলা আনসার ক্লাব চত্বরে এলাকার ধর্মপ্রাণ জনতা একত্রিত হয়। পরে নুরাল পাগলার আস্থানায় হামলা করে। এ সময় পুলিশের দুটি গাড়ি, ইউএনওর গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয় মাজারে। তখন নুরাল পাগলার অনুসারী ও উত্তেজিত জনতার ইট, পাথর নিক্ষেপে হযরত আলী (৫০),শাকিব শেখ (১৮), আ. আজিজ (৬০), আলামিন হাবিব (২৬), আলম মিয়া (৫০), মোয়াজ্জেম (২১), রাজু শেখ (৪২), রাতুল (১৭), আলমাস (২৫), হান্নান (২১),রাহেলা (৫৫), মুসা মোল্যা (৫০), মান্নান (৬৫), বিজয় কুমার সাহা (৮০), রাসেল (২৮), রিপন (২৬), সুমি (৩৬), মিথিলা (১৫), উজ্জ্বল (৪২), শিমুল হোসাইন (২৭), রাজবাড়ীর চিত্রগ্রাহক আব্দুল হালিম মিয়া, গোয়ালন্দ প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শহিদুল ইসলামসহ শতাধিক ব্যক্তি আহত হন। আহতদের গোয়ালন্দ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে সবাইকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার করেন।
এ ঘটনায় সেনাবাহিনী ও র্যাব ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে। ফায়ার সার্ভিসকর্মীরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করে। বিকেল ৪টার দিকে চারপাশ থেকে উত্তেজিত জনতা জড়ো হয়ে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে প্রশাসন সরে যেতে বাধ্য হয়। পরে উত্তেজিত জনতা নুরাল পাগলার আস্তানায় ঢুকে পড়ে। সেখানে বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট করে নিয়ে যায়। জনতা নুরাল পাগলার কবর ভেঙে বিশেষ কায়দায় কবর দেওয়া মরদেহ মিছিল করতে করতে ঢাকা-খুলনা মহাড়কে নিয়ে যায়। পদ্মার মোড়ে নিয়ে সড়কের উপর পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে মরদেহ পুড়িয়ে দেয়। বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে আবারও সেনাবাহিনী, ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ, র্যাব ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এদিকে, রাজবাড়ী, বালিয়াকান্দি, পাংশা, কালুখালী উপজেলায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে তৌহিদি জনতা। এর আগে সকালে নুরাল পাগলার পরিবারের পক্ষে গোয়ালন্দ প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
গত ২৩ আগস্ট নুরাল পাগলার মৃত্যু পর তার পরিবারের সিদ্ধান্তে তাকে নিজ বাড়ির সামনের অংশে দুইতলা সমান (প্রায় ১২ ফুট উঁচু) একটি কাঠামোর ভেতরে দাফন করা হয়। পরে কবরটিকে কাবা শরিফের আদলে রং করা হয় এবং ‘হযরত ইমাম মাহদী (আ.) দরবার শরিফ’ লেখা ব্যানার টাঙানো হয়। এ নিয়ে স্থানীয় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মধ্যে চরম অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে গোয়ালন্দ উপজেলার ইমাম পরিষদ ও তৌহিদি জনতা গত ২৬ আগস্ট বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেয়। তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানের লক্ষ্যে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে একাধিকবার মতবিনিময় সভা করা হয়। তৌহিদি জনতা ও ইমাম পরিষদের পক্ষ থেকে তিনটি দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবিগুলো হলো, কবর থেকে কাবা শরিফের আদলে করা রং পরিবর্তন, ‘ইমাম মাহদী (আ.) দরবার শরিফ’ লেখা সাইনবোর্ড অপসারণ এবং কবরের উচ্চতা কমিয়ে স্বাভাবিক করা।
নুরাল পাগলার ভক্ত ও পরিবারবর্গ প্রথম দুটি দাবি মেনে নিলেও কবরের উচ্চতা স্বাভাবিক করার বিষয়ে আলোচনার জন্য গত ২৮ আগস্ট পর্যন্ত সময় চায়। পরে গতকাল বৃহস্পতিবার (৪ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত সময় নেয়। এ বিষয়ে গতকাল ইমান আকিদা রক্ষা কমিটির ব্যানারে জেলার পাঁচটি উপজেলাতে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়।
গোয়ালন্দ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. নাহিদুর রহমান বলেন, এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। আমার গাড়ি, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) ও থানার ওসির গাড়ি ভাঙচুর করেছে জনতা। পরে নুরাল পাগলার আস্তানায় হামলা চালিয়েছে। তার মরদেহ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দিয়েছে। এতে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে। তবে সঠিক সংখ্যা এখনো বলতে পারব না। পরিস্থিতি এখন প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
রাজবাড়ী সিভিল সার্জন ডা. এস এম মাসুদ বলেন, হাসপাতালে ২২ জন ভর্তি ছিল। ২২ জনকেই ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেফার্ড করা হয়েছে। পুলিশ প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে বলা সম্ভব হচ্ছে না। এদিকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে হামলায় পুলিশের ছয় সদস্য আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনী এলে তাদের ওপরেও চড়াও হয় বিক্ষুব্ধ জনতা।
হামলায় ছয় পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন গোয়ালন্দ ঘাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ রাকিবুল ইসলাম। এর বাইরে এ বিষয়ে তিনি আর কোনো কথা বলতে রাজি হননি।
পুলিশ সুপার মো কামরুল ইসলাম, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ আল রাজীবসহ পুলিশের অন্য কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।