সংস্কারের আশায় ধাক্কা ও সংকট ঘনীভূত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে : টিআইবি

জুলাই সনদে রাজনৈতিক দলগুলোর মতপার্থক্য সত্ত্বেও যেসব সংস্কারে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোর সাংবিধানিক ও আইনগত বাস্তবায়ন কীভাবে হবে, সে প্রশ্ন এখনো অনিশ্চিত। ফলে সংস্কারের আশায় ধাক্কা লাগতে পারে, রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যাচ্ছে।
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এই পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে। গবেষণার শিরোনাম—‘কর্তৃত্ববাদী সরকার পতন-পরবর্তী এক বছর : প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি’।
রাজধানীর ধানমণ্ডির মাইডাস সেন্টারে আজ সোমবার (৪ আগস্ট) টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রকাশ করেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন টিআইবির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো শাহজাদা এম আকরাম ও মো. জুলকারনাইন।
জুলাই-আগস্ট গণহত্যায় জড়িতদের বিচার প্রক্রিয়া চলমান উল্লেখ করে ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজে ধীরগতি এবং কিছু কিছু বিভাগীয় পদক্ষেপের বাইরে বাস্তবে পুলিশের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর জবাবদিহির অগ্রগতি না থাকা সরকারের সদিচ্ছা ও সক্ষমতার ঘাটতি বলে মন্তব্য করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
টিআইবির পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ছাত্র-জনতার ওপর হামলাকারী, হত্যার ইন্ধনদাতা ও নির্দেশদাতাদের বিরুদ্ধে সারা দেশে ২০২৫ সালের ১ জুন পর্যন্ত ১ হাজার ৬০২টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে হত্যা মামলা ৬৩৮টি। ৭০ শতাংশ মামলার তদন্তে সন্তোষজনক অগ্রগতি এবং ৬০-৭০টি হত্যা মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে।
টিআইবির পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়, সরকার পতন পরবর্তী ১১ মাসে সারা দেশে পুলিশের বিরুদ্ধে ৭৬১টি মামলায় আসামি ১ হাজার ১৬৮ পুলিশ, এর মধ্যে ৬১ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ৪২৯টি অভিযোগ এবং ২৭টি মামলা হয়েছে। এতে শেখ হাসিনাসহ ২০৬ জন আসামি এবং গ্রেপ্তার ৭৩ জন।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, বিচার, নির্বাচন, রাষ্ট্র সংস্কারসহ নানা ক্ষেত্রে উদ্যোগ নেওয়া হলেও অন্তর্বর্তী সরকার বিগত এক বছরে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সুশাসনের আলোকে বিচার ও প্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ খাতে বেশ কিছু ঘাটতি দেখা গেছে। এতে দুর্নীতিমুক্ত ও জবাবদিহিমূলক সরকার গঠনের যে প্রত্যাশা ছিল, তা বাস্তবে পূরণ হয়নি।
পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সংস্কার কমিশনগুলো যেসব সুপারিশ দিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়নে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি নেই। কোথাও কোথাও কিছু সুপারিশ বেছে নেওয়া হয়েছে। আবার অনেক জায়গায় আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকার কোনো স্পষ্ট রোডম্যাপ বা পরিকল্পনা প্রকাশ না করায় বিভিন্ন সময় জনগণ ও অংশীজনদের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণে একধরনের তড়িঘড়ি বা ‘অ্যাড-হক’ মনোভাব দেখা গেছে। প্রশাসন চালাতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই সরকারের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ও সিদ্ধান্তহীনতা স্পষ্ট হয়েছে। প্রশাসনিক সংস্কারের ক্ষেত্রে দলীয় প্রভাবমুক্ত করার চেষ্টা করা হলেও বাস্তবে একদলীয়করণ থেকে সরে এসে আরেক দলীয় প্রভাব প্রতিষ্ঠার প্রবণতা দেখা গেছে। এতে প্রশাসনে অস্থিরতা ও কার্যকারিতা হ্রাস পেয়েছে।
পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া বিভিন্ন পক্ষের নিজস্ব এজেন্ডা সামনে আসায় মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। ফলে রাষ্ট্র সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথ আরও জটিল হয়ে পড়েছে। মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতভেদও স্পষ্ট।
তথ্য প্রকাশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এখনো বাধার মুখে রয়েছে বলে পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করা হয়। এতে বলা হয়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রভাব গত এক বছরে অনেক বেশি বেড়েছে। অনেক ক্ষেত্রে সহিংসতা ও বলপ্রয়োগের কারণে নারীর অধিকার, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে, যা বৈষম্যবিরোধী চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।